https://imrulkayesartgallery.blogspot.com/2025/06/blog-post.html

Saturday, April 12, 2025

কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের আহ্বান

 

কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের আহ্বান
ইমরুল কায়েস

‘বল বীর-/বল উন্নত মম শির!/শির নেহারী’ আমারি’ নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!’ ০১

মানবসত্ত্বার জয়োগান গাওয়া এমনই হিমালয়সম অহংবোধ নিয়ে বিংশ শতাব্দির উষালগ্নে যে কবিযুবরাজ অগ্নিদগ্ধ ধরিত্রীর বুকে সদর্ভে পা রেখেছিলেন, বাংলার সাহিত্যাকাশে বিদ্রোহের অগ্নিঝরা কণ্ঠ নিয়ে যিনি ‘ভগবানের বুকে এঁকে’ দিতে চেয়েছিলেন সাহসী পদচিহ্ন, বাংলা সাহিত্যের সেই আলোক বিচ্ছুরিত ক্ষণজন্মা ধুমকেতুর নাম কাজী নজরুল ইসলাম। জীর্ণতা ভরা এই পৃথিবীর সকল অত্যাচার, অবিচার, অসঙ্গতি, শ্রেণিভেদ ও দাসত্বের শৃঙ্খল ছিন্ন করে তিনি মানুষকে দিতে চেয়েছিলেন ক্ষুধামুক্ত, শোষণমুক্ত নতুন এক সমতার পৃথিবীর ঠিকানা। বিদ্রোহের ঝঙ্কার তুলে, শোষণের সুপ্রাচীন শৃঙ্খল ছিঁড়ে, ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠের খররৌদ্রদগ্ধ তপ্তপ্রহরে, আকাশ বিদীর্ণ চিৎকার ছুঁড়ে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন আমাদের এই মর্তের ধরণীতে।


জন্মেই তিনি বাঙালির আজন্মের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার কথা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন; নিপীড়িত গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আমজনতার আটপৌরে জনজীবনে লেপটে থাকা হাসি-কান্না ও সমাজ বিদীর্ণ করা হাহাকারের প্রতিধ্বনি তার জাদুকরী কণ্ঠে নিরন্তর অনুরণিত হয়েছে। জন্মই যার আজন্মের রণসংগ্রামের তরবারি হাতে নিয়ে তিনি তো আর তক্তপোশে আয়েশ করে মধুর সময় কাটাতে পারেন না। সমাজ-সংষ্কারে জীবনব্যাপী এই সংগ্রামের মেনিফেস্টোতে কবি স্পষ্টভাবে নিজেই ঘোষণা করেছেন 
        ‘আমি সেইদিন হব শান্ত,
        যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দণ-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
        অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না –
        বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
        আমি সেই দিন হব শান্ত। ০২
জীবনব্যাপি সংগ্রামে স্বেচ্ছায় নাম লেখানো অক্লান্ত সমরনায়ক কাজী নজরুল সমাজের গায়ে লেপটে থাকা হাজার বছরের অন্ধকার দূর করতে না পারলেও গণমানুষের হৃদয় মন্দিরে নিজের নামটি ঠিকই খোঁদাই করতে সক্ষম হয়েছেন। অত্যন্ত সঙ্গত ও প্রাসঙ্গিক কারণে বাঙালির যাপিত জীবনে তিনি এখন প্রাত্যহিক অনুসঙ্গ। গভীর শ্রদ্ধার সাথে তিনি বাঙালি জাতিস্বত্ত্বায় আষ্টে-পৃষ্ঠে মিশে আছেন এবং বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রের জাতীয় কবির সিংহাসনে তিনি স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল।

হিমালয়সম সৃজনীপ্রতিভার বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্র্যময় সম্ভার থেকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে খণ্ডিত কোনো বিষয়বস্তুর উপর আলোচনা করার প্রয়াস বিশাল মহাসমুদ্র থেকে নগণ্য নূড়ি কুড়ানোর মতো। উল্লেখ্য, আজকের প্রবন্ধের শিরোনাম করা হয়েছে, ‘কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের আহ্বান’, যৌক্তিকভাবে, রচনার শিরোনাম থেকে বেশি দূরে পরিভ্রমণ করার সুযোগ কোথায়? তবুও মূল প্রসঙ্গে প্রবেশের পূর্বে পাঠকের ভাবনাগুলোর শৈল্পিক সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে সংক্ষিপ্ত অবয়বে জাতীয় কবির জীবনী এবং কিছু প্রাসঙ্গিক শব্দ যেমন ‘সাম্যবাদ’, ‘মানবতা’, ‘সমাজ’, ‘সমাজতন্ত্র’, ‘অসম্প্রদায়িকতা’ ইত্যাদি শব্দসমুহের অর্থবিস্তারে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা প্রয়োজন।

কবির জীবনী:

কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মে (বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম দুখু মিয়া। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ এবং মাতার নাম জাহেদা খাতুন। অল্প বয়সেই নজরুল পিতা-মাতা দু’জনকেই হারান। শৈশব থেকেই দারিদ্র্য আর দুঃখ-কষ্ট ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। স্কুলের ধরাবাঁধা জীবনে কখনোই তিনি আকৃষ্ট হতে পারেননি। বারো বছর বয়সে তিনি লেটো গানের দলে যোগ দেন ও পালাগান লেখেন। পরে বর্ধমানে ও ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দরিরামপুর হাইস্কুলে লেখাপড়া করেন। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৯১৭ সালে ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে করাচি যান। যুদ্ধশেষে নজরুল কলকাতায় ফিরে আসেন ও সাহিত্য সাধনায় মনোনিবেশ করেন। তিনি কিছুদিন মসজিদে ইমামতিও করেন। সাপ্তাহিক ‘বিজলি’ পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পর সাহিত্যক্ষেত্রে তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে পরিচিতি পান।

তাঁর লেখায় তিনি বিদেশি শাসক, সামাজিক অবিচার ও অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। নজরুল সাহিত্য রচনা ছাড়াও কয়েক হাজার গানের রচয়িতা। তিনি বেশ কয়েকটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। তিনি গজল, খেয়াল ও রাগপ্রধান গান রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। আরবি-ফারসি শব্দের সার্থক ব্যবহার তাঁর কবিতাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। তিনি রবীন্দ্রনাথের তৈরি করা পথে না চলে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে নিজেকে বিকশিত করেছেন; সাহিত্যে এনেছেন সাম্যবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা। গল্প, উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধ রচনায়ও তিনি কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। সম্পাদক এবং সমালোচক হিসেবেও নজরুল খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি মূলত যৌবনের কবি। যৌবনের ধর্মই হলো এক দিকে যেমন বিদ্রোহ এবং প্রতিবাদ, অন্যদিকে প্রেম। এ দু’টো অনুভূতিরই সূচনা হয় আবেগের প্রাবল্য থেকে। নজরুলের ভাষণ, সম্পাদকীয়, সমালোচনা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প প্রতিটি ক্ষেত্রই ভাষার কাব্যিক ব্যঞ্জনা এবং বলিষ্ঠতায় পরিপূর্ণ।

তিনি দৈনিক ‘নবযুগ’, ‘ধূমকেতু’ ও ‘লাঙল’ পত্রিকায় সম্পাদকের কাজ করেছেন। মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ১৯৭২ সালে কবিকে ঢাকায় আনা হয় এবং তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করা হয়। কবিকে ঢাকা ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ডিলিট, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক, ভারত সরকার ‘পদ্মভূষণ ও বাংলাদেশ সরকার ‘একুশে পদক প্রদান করে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।

কিছু প্রাসঙ্গিক শব্দ বিশ্লেষণ:

মানবতা:

মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া, মমতা বা সমাজের প্রতিটি সদস্যের স্বার্থের প্রতি গভীর অনুরাগই হলো মানবতা। এটি সাধারণ মানুষের প্রয়োজন ও সমস্যাবলি যৌক্তিকভাবে সমাধানে কাজ করে। পরোপকার, দয়া, ক্ষমা প্রভৃতি মনুষ্যোচিত গুণাবলি মানবতা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হীনতা, লালসা ও সংকীর্ণতাকে পরিত্যাগ করে চরিত্রকে সুষমামণ্ডিত করতে পারলে মানবতার উৎকর্ষ সাধিত হয়। যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ মূলতঃ মানুষকে কেন্দ্র করে হয়েছে। সকল ধর্মের মূল শিক্ষা হল মানবতা। মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নায় ধর্ম তার আবেদনময়ী হাত প্রসারিত করেছে। একটি সুন্দর সমাজ গড়তে হলে প্রয়োজন মানবতা। তিনিই ধর্মের প্রকৃত অনুসারী, যিনি মানবতার শিখা জ্বালান। সমাজে সেই ব্যক্তির মর্যাদা উচ্চ, যিনি সর্বদা মানবতার উন্নতির জন্য কাজ করেন। আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী ও নীতিশাস্ত্র ইউনিয়নের মতে:

“মানবতা একটি গণতান্ত্রিক এবং নীতিগত জীবন অবস্থান, যা নিশ্চিত করে যে মানুষের নিজস্ব জীবনকে অর্থ এবং রূপ দেওয়ার অধিকার এবং দায়িত্ব রয়েছে। এটি যুক্তির চেতনায় এবং মানবিক ক্ষমতার মাধ্যমে মুক্ত অনুসন্ধানের মাধ্যমে মানবিক এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে একটি নীতিশাস্ত্রের মাধ্যমে আরও মানবিক সমাজ গঠনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এটি ঈশ্বরবাদী নয় এবং বাস্তবতার অতিপ্রাকৃত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে না।” ০৩

সাম্যবাদ:
‘সাম্যবাদ’ শব্দটি ইংরেজি “কমিউনিজম” শব্দের বাংলা অনুবাদ। শব্দটি মুলতঃ কল্পনাপ্রসুত একটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতবাদ যা একটি কল্যাণমুখি সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে সমাজে কোনো শ্রেণি, অর্থ ব্যবস্থাপনা এবং রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনা করা হয় না এবং উৎপাদনের মাধ্যমের সাধারণ মালিকানার উপর ভিত্তি করে সমাজ গঠিত হয়। অনলাইনে শব্দটির অর্থ অন্বেষণ করতে গেলে বিশ্বজনীন স্বীকৃত তথ্যকোষ (ওয়েবসাইট) ‘উইকিপিডিয়া’য় পাওয়া গেলো:

“সাম্যবাদ বা কমিউনিজম হল শ্রেণিহীন, শোষণহীন, ব্যক্তিমুনাফাহীন এমন একটি রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ভাবাদর্শ যেখানে ব্যক্তিগত মালিকানার স্থলে উৎপাদনের সকল মাধ্যম এবং প্রাকৃতিক সম্পদ (ভূমি, খনি, কারখানা) রাষ্ট্রের মালিকানাধীন এবং নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে। সাম্যবাদ হল সমাজতন্ত্রের একটি উন্নত এবং অগ্রসর রূপ, তবে এদের মধ্যেকার পার্থক্য নিয়ে বহুকাল ধরে বিতর্ক চলে আসছে। তবে উভয়েরই মূল লক্ষ্য হল ব্যক্তিমালিকানা এবং শ্রমিক শ্রেণির উপর শোষণের হাতিয়ার পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার অবসান ঘটানো।” ০৪


অসাম্প্রদায়িকতা((Cosmopolitanism):
‘অসাম্প্রদায়িকতা একটি দর্শন। ব্যক্তির মনন নিঃসৃত একটি আদর্শিক ও সামাজিক মতবাদ যা একটি শ্রেণিহীন, বৈষম্যহীন সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে। বিশ্বজনীন স্বীকৃত তথ্যকোষ (ওয়েবসাইট) ‘উইকিপিডিয়া’য় শব্দটির বাংলা অর্থ খোঁজ করলে পাওয়া যায়:

“অসাম্প্রদায়িকতাবাদ বা অসাম্প্রদায়িকতা (Cosmopolitanism) হল একটি আদর্শিক মতবাদ যেখানে সকল মানুষ পারস্পারিক নৈতিকতা ভাগাভাগির বা বিনিময়ের মাধ্যমে একটি একক সম্প্রদায়ের সদস্য হবে। যে ব্যক্তি অসাম্প্রদায়িকতার ধারণাকে যে কোন আকারে নিজের মাঝে ধারণ করেন তাকে একজন অসাম্প্রদায়িক বা ইংরেজিতে cosmopolitan বা cosmopolite বলা হয়।০৫

সমাজ:
সমাজ বলতে এমন একটি স্থান বা ব্যবস্থা বোঝায়, যেখানে একাধিক চরিত্র একত্রে কিছু নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠা করে একত্রে বসবাসের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলে। মানুষের ক্ষেত্রে একাধিক ব্যক্তি একত্র হয়ে লিখিত কিংবা অলিখিত নিয়ম-কানুন তৈরি করে অথবা প্রথাগত আচরণের মাধ্যমে সৃষ্টি আইন-কানুন; এরকম একত্র বসবাসের ব্যবস্থাকে সমাজ বলে। মানুষ ছাড়াও বিভিন্ন প্রাণির ক্ষেত্রেও সমাজের অস্তিত্ব দৃশ্যমান। কিন্তু, সেখানে মানুষের মতো সুদৃঢ় কাঠামোবদ্ধ সমাজের দৃষ্টান্ত নজরে আসে না।

সমাজতন্ত্র (Socialism):   

সমাজতন্ত্র হলো বিশেষ এক ধরণের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে উৎপাদনের উপকরণের সামাজিক মালিকানা এবং অর্থনীতির একটি সমবায়ভিত্তিক সামাজিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত করে; এটি একটি রাজনৈতিক মতবাদ ও আন্দোলন যার লক্ষ্য হচ্ছে এই ধরণের সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্র একই জিনিস। সমাজতন্ত্রের উঁচু ও সেরা রূপের নাম সাম্যবাদ। সমাজতন্দ্রে ব্যক্তি মালিকানার নিয়ম নাই। সংবিধিবদ্ধ রাষ্ট্র বলে কিছু থাকে না। প্রলেতারিয়েত বা শ্রমিক শ্রেণির প্রতিনিধিরা সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন নিশ্চিত করে। সমাজতন্ত্রের উল্টোপীঠে পুজিবাদের অবস্থান। বাংলাদেশের সংবিধানে ‘সমাজতন্ত্র’কে "একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার উপকরণ" হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

“এটি এমন একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে সম্পদ ও অর্থের মালিকানা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন অর্থাৎ কোনো ব্যক্তিমালিকানা থাকে না। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনসাধারণের প্রয়োজন অনুসারে পণ্য উৎপাদন হয়। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে একটি দেশের কলকারখানা, খনি, জমি ইত্যাদি সামাজিক রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়।” ০৬

 
কাজী নজরুল ইসলাম এর বৈচিত্রময় সমগ্রজীবন এবং তার পাহাড়সম রচনা সম্ভার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করলে মানবতা, কমিউনিজম বা সাম্যবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ইত্যাদি শব্দসমুহের সাথে তার অছেদ্য সম্পর্ক সহজেই প্রতীয়মান হবে; আরো শক্ত করে বলতে গেলে উল্লিখিত শব্দসমুহ কাজী নজরুল ইসলাম সমার্থক ও পরিপূরক।

নজরুলের মননে অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল কৈশোরের সূচনাতেই যা পরবর্তীতে তাকে সাম্যবাদী হওয়ার ক্ষেত্র সুদৃঢ় ভূমিকা পালন করে। ‘রাণীগঞ্জে থাকাকালীন নজরুলের জীবনে এসেছিলে শৈলেন্দ্রকুমার ঘোষ এবং শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় নামে দুই জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু; একজন খ্রিষ্টান আর একজন হিন্দু-ব্রাহ্মণ। হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিষ্টান - তিনবন্ধু একসঙ্গে খেলাধূলা করতেন, একসঙ্গে বেড়াতেন। তিন ধর্মের তিন বন্ধুর একত্রে মেলামেশার কারণেই নজরুলের ভেতর সেই কৈশোর থেকেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা গেড়ে বসেছে। পরবর্তীতে তারই প্রতিফলন তাঁকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মনন গঠনের ভিত্তি তৈরি করেছে।

কাজী নজরুল ইসলাম অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লেখার মাধ্যমে সমাজ তথা রাষ্ট্রের পরিবর্তনের জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। এখানেই তিনি ছিলেন সমসাময়িক অন্যান্য কবির থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তিনি একটি বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক মানবসমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। মূলতঃ কবিতার মাধ্যমেই নজরুল তাঁর সাম্যবাদী আদর্শের জানান দেন। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি’ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এই কবিতাটিই তাঁর তার ভিতোরকার সাম্যবাদী চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছে। নজরুল ‘সাম্যবাদী’ কবিতাটি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র দপ্তরে পাঠান। সেই সুবাদেই বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সংগঠক মুজফ্‌ফর আহমদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ও পরিচয় হয়। নজরুল কমরেড মুজাফ্‌ফর আহমদের সাহচর্যে এসেই আরও বেশি সাম্যবাদী আদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়েন। নজরুল কর্তৃক প্রকাশিত ও পরিচালিত ‘ধূমকেতু’, ‘লাঙল’, ‘নবযুগ’, ‘গণবাণী’ প্রভৃতি পত্রিকা হয়ে ওঠে সাম্যবাদী চিন্তার মুখপত্র। 


কাজী নজরুল ইসলামেরসাম্যবাদ’ প্রকটভাবে প্রকাশ পেয়েছে তারসাম্যবাদীকাব্যগ্রন্থে। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে কাব্যগ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়।সাম্যবাদীকাব্যগ্রন্থে মোট ১১টি কবিতা স্থান পেয়েছে; সাম্যবাদী’, ‘নারী’, ‘মানুষ’, ‘বারাঙ্গনা’, ‘রাজা-প্রজা’, ‘ঈশ্বর’, ‘পাপ’, ‘কুলি-মজুর’, ‘চোর-ডাকাত’, ‘সাম্যকাণ্ডারি হুঁশিয়ার

উল্লিখিত কবিতা ছাড়াও কাজী নজরুলের আরো অনেক কবিতায় সাম্যবাদের বলিষ্ঠ উচ্চারণ প্রতিধ্বনিত হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম কবিতাগুলো হলো—‘প্রলয়োল্লাস’, ‘বিদ্রোহী’, ‘সর্বহারা’, ‘সাম্যের গান’, ‘মানুষ’, ‘আনন্দময়ীর আগমনে’, ‘কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার পাশা’, ‘ভাঙার গান’, ‘বন্দি বন্দনা’, ‘রণভেরি’, ‘আত্মশক্তি’, ‘মরণ বরণ’, ‘বন্দনাগান’, ‘আগমনী’, ‘ধূমকেতু’, ‘ধীবরদের গান’, ‘কৃষাণের গান’, ‘দীপান্তরের বন্দিনী’, ‘শ্রমিকের গান’, ‘মুক্তিসেবকের গান’, ‘ছাত্রদলের গান’, ‘সাবধানী ঘণ্টা’, ‘উদ্বোধনপ্রভৃতি।

কবিতা: সাম্যবাদী:

‘সাম্যবাদী’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বরে লেবার স্বরাজ পার্টির মুখপত্র হিসেবে খ্যাতসাপ্তাহিক লাঙলপত্রিকায়। কাজী নজরুল ইসলামকেলাঙল’-এর প্রধান পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।লাঙল’-এর প্রথম সংখ্যাতেই কাজী নজরুলসাম্যবাদী’ নামের কবিতাটি লিখলেন। নজরুলের এই কবিতাটিতে ‘সাম্যবাদের সবচেয়ে পরিশীলিত ও গ্রহণযোগ্য অর্থের প্রতিধ্বনি শোনা যায়:

            “গাহি সাম্যের গান-

যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,

যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রিশ্চান।

গাহি সাম্যের গান!

কে তুমি? –পার্সি? জৈন? ইহুদি? সাঁওতাল, ভীল, গারো?

কন্ফুসিয়াস? চার্বাক চেলা? বলে যাও, বল আরো!

বন্ধু, যা খুশি হও,

পেটে-পিঠে, কাঁধে-মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,

কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-

জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থ-সাহেব পড়ে যাও যত শখ,-

কিন্তু, কেন এ পণ্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?

দোকানে কেন এ দর কষাকষি? পথে ফোটে তাজা ফুল!” ০৭

সাম্যবাদের সুর স্পষ্ট করতে একই কবিতার নীচের অংশে কবি আরো লিখেছেন:

“বন্ধু বলিনি ঝুট,

এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট।

এই হৃদয়ে সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,

বুদ্ধ গয়া এ, জেরুজালেম এ,মদিনা, কাবা-ভবন,

মজজিদ এই,মন্দির এই, গীর্জা এই হৃদয়,

এইখানে বসে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।” ০৮

কবিতাটির একদম শেষ লাইনে তিনি ঘোষাণা করেছেন:

--- মিথ্যা শুনিনি ভাই,

এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির-কাবা নাই। ০৯


কবিতা: সাম্য:

প্রকাশকাল: ১৯২৫ খ্রি. কাব্যগ্রন্থ: সাম্যবাদী। কবিতায় তিনি শ্রেণিহীন, বৈষম্যহীন, মানবতাবাদী এক অসাম্প্রদায়িক সমাজের সচিত্র রুপরেখা আবিষ্কার করে তিনি তার পাঠক ও ভক্তবৃন্দকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। উপমহাদেশের তখনকার পাড়া-মহল্লায় চলমান শ্রেণি-বিভক্তি ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে উত্তাল ভারতীয় সমাজে বাস করে তিনি এ কোন সমাজের ছবি দেখালেন! মানুষের জয়গান গাইতে যেয়ে কবিতার শুরুতেই তিনি উপস্থাপন করলেন তার জড়তাহীন দৃপ্ত উচ্চারণ:

“গাহি সাম্যের গান-

বুকে বুকে হেতা তাজা ফুল ফোটে, মুখে মুখে তাজা প্রাণ!

বন্ধু, এখানে রাজা-প্রজা নাই, নাই দরিদ্র-ধনী,

হেতা পায় না ক কেহ ক্ষুদ-ঘাটা, কেহ দুধ-সর-ননী।” ১০

একই কতিায় তিনি আরো ঘোষণা করেন:

“সাম্যবাদী-স্থান-

নাই কো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গোরস্থান।

নাই কো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গীর্জা-ঘর,

নাই কো পাইক বরকন্দাজ নাই পুলিশের ডর।

এই সে স্বর্গ, এই সে বেহেশত, এখানে বিভেদ নাই,

যত হাতাহাতি হাতে হাত রেখে মিলিয়েছে ভাই ভাই!” ১১

এখানেও. একদম শেষ লাইনে তিনি উচ্চারণ করেছেন:

পায়জামা প্যান্ট ধুতি নিয়া হেতা হয় না ক’ ঘুষাঘুষি

ধুলায় মলিন দুধের পোশাকে এখানে সকলে খুশি।


কবিতা: কুলি-মজুর:

প্রকাশকাল: ১৯২৫ খ্রি. কাব্যগ্রন্থ: সাম্যবাদী। জীর্ণতা ভরা এই পৃথিবীর সকল অত্যাচার, অবিচার, অসঙ্গতি, শ্রেণিভেদ ও দাসত্বের শৃঙ্খল ছিন্ন করে কবি মানুষকে দিতে চেয়েছিলেন ক্ষুধামুক্ত, শোষণমুক্ত, মানবতাবাদী নতুন এক সমতার পৃথিবীর ঠিকানা যা আমরা খুঁজে পেয়েছি তার ‘সাম্য’ কবিতায়। কিন্তু ‘কুলি-মজুর’ কবিতায় কবির স্বপ্নের মডেল সমাজ-ব্যবস্থা খুঁজে পাওয়া গেলো না। যে কারণে কবির বিদ্রোহী সত্ত্বা ‘কুলি-মজুর’ কবিতায় প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠতে দেখা গেলো:

“দেখিনু সেদিন রেলে,

কুলি বলে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে।

চোখ ফেটে এল জল

এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দৃর্বল?” ১৩

কবির বিদ্রোহী রণরূপ ও প্রতিবাদী উচ্চারণ আরো ধারালো শুনতে পাই এই কবিতার মাঝ দিকের পঙক্তিমালায়…

“আসিতেছে শুভদিন,

দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হেইবে ঋণ!

হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায় ভাঙিল যারা পাহাড়,

পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,

তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,

তোমারে বহিতে মযারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;

তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদের গান,

তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!

তুমি শুয়ে র’বে তেতালার ‘পরে, আমরা রহিব নিচে,

অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে-ভরসা আজ মিছে!” ১৪

 

কবিতা: মানুষ

প্রকাশকাল: ১৯২৫ খ্রি. কাব্যগ্রন্থ:সাম্যবাদী। কাজী নজরুল ইসলাম মানুষের মানবিক সত্ত্বাকে জাগরুক করে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেছেন। স্থান-কাল-পাত্রের ভেদ তুচ্ছ করে অভিন্ন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার চূড়ান্ত অভিপ্রায় প্রকাশিত হয়েছে কবির বিখ্যাত এই ‘মানুষ’ কবিতায়:

“গাহি সাম্যের গান-

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!

নাই দেশ কাল–পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,

সব দেশে, সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞ্যাতি।”১৫


কবিতা: নারী

প্রকাশকাল: ১৯২৫ খ্রি. কাব্যগ্রন্থ:সাম্যবাদী। কবি নজরুল উপলব্দি করেছিলেন শোষণমুক্ত, ক্ষুধামুক্ত, শ্রেণিহীন, বৈষম্যহীন একটি আদর্শ সমাজ গড়তে হলে প্রথমেই সামাজিক শ্রেণি-বিভক্তির দেয়াল ভেঙ্গে ফেলতে চেয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মাঝে বিদ্যমান অমিল দূর করতে চেয়েছিলেন; ধনী-গরীব, নারী-পূরুষ ও সাদা-কালোর মাঝে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করে একটি বৈষম্যহীন নতুন সমাজ ব্যবস্থা উপহার দিতে চেয়েছিলেন। ‘নারী’ কবিতায় তিনি নারী-পূরুষের সমমর্যাদা ঘোষণা করে মূলতঃ সমাজের অবহেলিত সম্প্রদায় নারীদের জয়োগান গেয়েছেন:

“সাম্যের গান গাই-

আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।

বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি

অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।” ১৬

মানব সভ্যতা বিনির্মাণে নারী ও পুরুষের সমান ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা স্মরণ করে দিয়ে পুরুষ শাসিত সমাজে তিনি নারীর ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। তিনি নারীর ভিতরে ঈশ্বরপ্রদত্ত্ব ক্ষমতার স্ফুরণ ঘটিয়ে সমাজে তাদেরকে একটি সম্মানজনক স্থানে অধিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। একই কবিতায় তিনি আরো লিখেছেন:

“তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছ তার প্রাণ?

অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান।

জ্ঞানের লক্ষ্মী, গানের লক্ষ্মী, শস্য-লক্ষ্মী নারী

সুষমা-লক্ষ্মী নারীই ফিরিছে রুপে ‍রুপে সঞ্চারি’।

পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ,

কামিনিী এনেছে যামিনী-শান্তি, সমীরণ, বারিবাহ।

দিবসে দিয়াছে শক্তি সাহস, নিশীথে হয়েছে বধু,

পূরুষ এসেছে মরুতৃষা লয়ে, নারী যোগায়েছে মধু।” ১৭

মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় প্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ অর্জনের সাথে পুরুষের বীরত্বগাঁথার পাশাপাশি নারীর কীর্তিগাঁথার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইতিহাস এই কবিতায় ব্যক্ত হয়েছে। সমাজে নারীর ক্ষমতাকে করুণা দিয়ে নয়, বরং মর্যাদার দৃষ্টি দিয়ে দেখার আহ্বান করেছেন কবি। তিনি লিখেছেন:

“কোনো কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারি,

প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।

রাজা করিতেছে রাজ্য-শাসন, রাজারে শাসিছে রানী,

রানীর দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজার যত গ্লাণি।”১৮

সকল শ্রেণি-বিভক্তি ও বৈষম্যের দেয়াল ভেঙ্গে কবির মানসপটে চিত্রিত অসম্প্রদায়িক ও মানবিক সমাজ গড়তে হলে নারীর প্রতি অমর্যাদার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে কবি বোঝাতে চেয়েছেন নারীর প্রতি অবহেলার দিন শেষ।

“সে-যুগ হয়েছে বাসী,

যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক, নারীরা আছিল দাসী!

বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,

কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি’।” ১৯

 

কবিতা: পাপ

প্রকাশকাল: ১৯২৫ খ্রি. কাব্যগ্রন্থ:সাম্যবাদী। ‘পাপ’ কবিতায় কবি পাপীদেরকে ঘৃণার চোখে না দেখে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস করা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছে সমাজে বসবাসরত সবাই কমবেশি পাপে নিমজ্জিত; কাউকে পাপী শ্রেণিভুক্ত না করে তিনি অভিন্ন সমাজ নির্মাণের তাগিদ দিয়ে তিনি লিখেছেন:

“সাম্যের গান গাই।

যত পাপী-তাপী সব মোর বোন, সব হয় মোর ভাই।

এ পাপ-মুল্লুকে পাপ করেনি ক’ কে আছে পুরুষ-নারী?

আমরা তো ছার; -পাপে পঙ্কিল পাপীদের কাণ্ডারি!” ২০


কবিতা: রাজা-প্রজা

প্রকাশকাল: ১৯২৫ খ্রি. কাব্যগ্রন্থ:সাম্যবাদী। নজরুলের সাম্যবাদী ভাবনাগুলো খুবই সরলভাবে উপস্থাপিত তার লেখা ‘রাজা-প্রজা’ কবিতায়। তিনি অকপটে প্রশ্ন ছুঁড়েছেন- একই ধরণীতে, একই আকাশের নীচে বাস করে কেন কেউ রাজা হবে, কেউ হবে প্রজা?

“সাম্যের গান গাই

যেখানে আসিয়া সম-বেদনায় সকলে হয়েছি ভাই।

এ প্রশ্ন অতি সোজা,

এক ধরণীর সন্তান, কেন কেউ রাজা, কেউ প্রজা?” ২১


কবিতা: কাণ্ডারি হুশিয়ার
কাজী নজরুল ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী চিন্তায় আপাদমস্তক নিমজ্জিত একজন দেশপ্রেমিক। তিনি মর্মে মর্মে অনুভব করতেন মানবধর্মকে, মানুষকেমানবীয় চেতনাকে। তাই তো অধিকাংশ কবিতায় ‘সাম্যবাদ’ প্রধান উপজীব্য বিষয় হয়ে উঠেছে। কাজী নজরুল মানবপ্রেমের সঙ্গে দেশপ্রেম মিশিয়ে মানবতাকে সমুজ্জ্বল করেছেন। মাতৃভূমির দুর্দিনে দেশপ্রেম জাগরুক করার জন্য তিনি বারবার তার দেশবাসিকে সতর্ক করেছেন:
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
                কান্ডারি! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
                 হিন্দু না ওরা মুসলিম? জিজ্ঞাসে কোন্ জন?
                কান্ডারি! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার। ২২

কবিতা: হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ
 ‘হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ কবিতায় এই উপমহাদেশে সৃষ্টি হওয়া হিন্দু-মুসলীম দাঙ্গার ভয়াবহ ও ব্যাঙ্গাত্মক চিত্র উঠে এসেছে অবলীলায় যেখানে তিনি সাম্প্রাদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রেখে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার সংগ্রামে লিপ্ত। কবি অত্যান্ত দুঃখের সাথে লিখেছেন:

মাভৈ! মাভৈ! এত দিনে বুঝি জাগিল ভারতে প্রাণ,

সজীব হইয়া উঠিয়াছে আজ শ্মশান-গোরস্তান!

ছিল যারা চির-মরণ-আহত,

উঠিয়াছে জাগি ব্যথা জাগ্রত,

খালেদ আবার ধরিয়াছে অসি, অর্জুন ছোঁড়ে বাণ।

জেগেছে ভারত, ধরিয়াছে লাঠি হিন্দু-মুসলমান।

মরে হিন্দু, মরে মুসলিম উহার ঘায়ে আজ,

বেঁচে আছে যারা মরিতেছে তারা, মরণে নাহি লাজ।২৩

 

কাজী নজরুল ইসলাম এর মতো ইংরেজ কবি ‘পার্শি বিশি শ্রেলী’র কবিতাতেও আমরা বিদ্রোহের সুর শুনতে পাই; যদিও দুই কবির বিদ্রোহীসত্ত্বার ধরণ কিছুটা আলাদা। ‘‘‘Ode to the West Wind’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-

“Wild Spirit, which art moving everywhere;

Destroyer and Preserver; hear, O hear!” ২৪

কবিতায় তিনি পুরাতন ও চলমান ঘুনেধরা সমাজকে ভেঙ্গে চুরে তছনছ করে দিতে চেয়েছেন একই সাথে কবিতার শেষ দিকে তিনি চরম আশাব্যঞ্জক পঙক্তিমালা ছুঁড়ে দিয়ে তিনি তার কাঙ্ক্ষিত সমাজ ব্যবস্থা খুঁজে পেতে চেয়েছেন:

“The trumpet of a prophecy! O Wind,
If Winter comes, can Spring be far behind?”
২৫

কিন্তু ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের এই ঘুণে ধরা সমাজকে ধ্বংশ করতে কবিতার পরতে পরতে হাতুড়ি শাবল চালাতে দেখেছি। কিন্তু সাম্যবাদী চেতনায় লেখা নজরুলের অন্যান্য অনেক কবিতার মর্মার্থ যদি একটি টেবিলে একত্রে উপস্থাপন করা যায় তাহলে দুই জগতের দুই কবিতার বিদ্রোহী সত্ত্বার মাঝে যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়:

“আমি চিরদুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,

মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস,

আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর!

আমি দুর্বার,

আমি ভেঙ্গে করি সব চুরমার!

আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,

আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!

আমি মানি না কো কোন আইন,

আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!

আমি ধুর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর!

আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর!
               বল বীর-
               চির-উন্নত মম শির!”২৬

কাজী নজরুল ইসলাম মার্ক্সিস্ট মতাদর্শে গভীরভাবে আকৃষ্ট ছিলেন। নজরুল রচিত সাম্যবাদী’, ‘ঈশ্বর’, ‘মানুষ’, ‘নারী’, ‘পাপ’, ‘কুলি-মজুর’ ইত্যাদি কবিতা তারই নিদর্শন। এসব কবিতার মাধ্যমে তিনি মার্ক্সিজমের মতাদর্শকে সমুন্নত রেখে শ্রমিক মেহনতি মানুষের কথা তুলে ধরেছেন।গণবাণীতেই নজরুল ১৯২৭ সালে মে দিবসে শ্রমজীবীদের আন্তর্জাতিক সংগীত বাইন্টারন্যাশনালগানের বঙ্গানুবাদ করেন। গানটি ফরাসি শ্রমিক কবি ইউজিন পাতিয়ের রচিত। গানটি এখনো সারা বিশ্বের কমিউনিস্টরা তাদের দলীয় সংগীত হিসেবে গেয়ে থাকেন। সাম্যবাদী কবি পরবর্তীকালে ধারাবাহিকভাবে লেখেন, ‘শ্রমিকের গান’, ‘লাল পতাকার গান’, ‘ধীবরের গানইত্যাদি শ্রমজীবী অংশের মানুষের শ্রেণিচেতনার গান। মার্ক্সীয় চেতনার গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে নজরুলেরসাম্যবাদীসর্বহারাকবিতায়।আমার কৈফিয়ৎকবিতায় প্রকাশ পেয়েছে মেহনতি মানুষের হৃদয়ের বেদনার কথা।

“ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দু’টো ভাত একটু নুন

বেলা বয়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বালা আগুন!

কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়,

স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!

কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছ কি? কালি ও চুন

কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?” ২৭

যুগে যুগে দেশে দেশে দেখা গেছে সাম্যবাদীরাই মূলতঃ অসাম্প্রদায়িক হয়। কাজী নজরুল ইসলামও ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক মূর্ত প্রতীক। তিনি মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ করেননি, তাঁর কাছে মানুষের কোনো জাতপাত ছিল না। সবার মাঝে শুধুমানুষ’ পরিচয়টাই তিনি খুঁজে ফিরেছেন আজীবন। নজরুলের কবি চেতনায় যে সাম্যবাদী মূল্যবোধ প্রখরভাবে ক্রিয়াশীল ছিল, তা ঈদ বিষয়ক কবিতাগুলোয় এর প্রমাণ পাওয়া যায়। রিক্ত-নিঃশ্ব ও না খেয়ে থাকা অভূক মানুষের জীবনে ঈদের খুশি কীভাবে আসে? তিনি তাঁর সাম্যবাদী কলমের খোঁচায় তুলে ধরেছেন নিঃস্ব মানুষের জীবনের চালচিত্র; হানা দিয়েছেন আমাদের ঘুণে ধরা সমাজের ভোঁতা মগজে। বিভিন্ন কবিতায় ইসলামী সাম্যবাদী চেতনাকে তিনি সর্বজনীন রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তার লেখা নতুন চাঁদ কবিতায়ও চেতনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে

সাম্যেও রাহে আল্লাহের

মুয়াজ্জিনেরা ডাকিবে ফের,

--------------------------------

রবে না ধর্ম জাতির ভেদ

রবে না আত্ম-কলহ ক্লেদ। ২৮

সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’— মর্মবাণী নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে মহিমান্বিত করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক, খ্রিষ্টান হোকনিপীড়িত মানবতার একটাই পরিচয়, তারা শোষিত-বঞ্চিত মানুষ। আর তাঁর কলম সব সময় শোষিত, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত মানুষের জন্য সোচ্চার ছিল। নজরুলের সাম্যবাদী ভূমিকার জন্যই সে সময় তিনি সমধিক পরিচিতি লাভ করেন। কারণ, তিনি মানুষের শোষণকে, নির্যাতনকে সরাসরি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন।


কবির নিজের মুখের এই দার্শনিক উচ্চারণে লুকিয়ে আছে মহাবিশের মহাকাল সম্পর্কে কবির পরিচ্ছন্ন ধারণা। এই বিশ্বচরাচরে, মহাশূণ্যতার মাঝে তন্নতন্ন করে কবি খুঁজে ফিরেছেন জীবন-সংসার ও মানবসৃষ্টির প্রকৃতি রহস্য। বাংলা কবিতায় কাজী নজরুল এনেছিলেন সাম্যবাদের সুর, প্রচার করেছিলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনুপম সহাবস্থান। তার কবিতা ও সংগীতে যেমন স্থান পেয়েছে ইসলামী জীবন-দর্শন, তেমনি শ্যামা-সংগীত  ও সনাতন জীবনাদর্শ তার মানবিক মূল্যবোধে এনেছে তাৎপর্যপূর্ণ বৈচিত্র। ‘মানবপ্রেম’ কবির ব্যক্তি-জীবন ও মানবিক সত্ত্বাকে করেছিল মহিমান্বিত। প্রেমের আকুতি, অপ্রাপ্তি ও অতৃপ্তি তার কাব্যসরোবরে যেসব ফুল ফুটিয়েছিল সে ফুলগুলো নানা বর্ণে, গন্ধে ও সৌরভে বিকশিত হয়ে কবির অন্তর্জগতে সৃষ্ঠি করেছিল গভীরতম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার পবিত্র মন্দির। ‘আর বাঁশি না বাজে’ অভিভাষণে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন:

’যেদিন আমি চলে যাবো, সেদিন হয়তো বড় বড় সভা হবে। কত প্রশংসা, কত কবিতা বেরোবে আমার নামে; দেশ্রপ্রমিক, ত্যাগী, বীর-বিদ্রোহী, বিশেষণের পর বিশেষণ! টেবিল ভেঙ্গে ফেলবে থাপ্পড় মেরে বক্তার পর বক্তা। সেই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধদিনে বন্ধ,ু তুমি যেন যেও না। যদি পার, চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ করো...’২৯

তিনি সব ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মানবধর্মকেই উচ্চাসনে বসিয়েছেন। মানবের মাঝে তিনি স্রষ্টাকে আবিষ্কার করেছেন। কেননা সৃষ্টিকর্তা তার সৃষ্ট জীব মানুষকেআশরাফুল মাখলুকাতবাসৃষ্টির সেরা জীববলে ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে কবি নজরুলের সাম্যবাদ স্রষ্টাকে অস্বীকার করে নয়। কাল মার্কসের মতো তার সাম্যবাদ নাস্তিক্য সাম্যবাদ নয়। তার সাম্যবাদ আস্তিক্য সাম্যবাদ। অসাম্প্রদায়িক হলেও তিনি পুরোপুরি আস্তিক ছিলেন আর বাঁশি না বাজে’ অভিভাষণে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন:

“যদি কোন দিন আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকীত্বের পরম শূন্যতা থেকে অসময়ে নামতে হয় তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না আমি সেই নজরুল; সেই নজরুল অনেকদিন আগে মৃত্যুর খিড়কি দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। মনে করবেন পূর্ণত্বের তৃঞ্চা নিয়ে যে অশান্ত তরুন এই ধরায় এসেছিল, অপূর্ণতার বেদনায় তার বিগত আত্মা যেন স্বপ্নে আমাদের মাঝে কেঁদে গেল...” ৩০

আমরা দেখতে পাই, কাজী নজরুলের কবিতার প্রধান বিষয় বিপ্লব আর সাম্যবাদ। যুগ-চেতনা তাকে বিপ্লবের মন্ত্র শিখিয়েছে আর সামাজিক বৈষম্য তাকে সাম্য প্রতিষ্ঠায় আগ্রাসী করে তুলেছে। আর বাঁশি না বাজে’ অভিভাষণে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন:

“আমাকে বিদ্রোহী বলে খামাখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এই নীরিহ জাতটাকে আঁচড়ে-কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়ানোর ইচ্ছা আমার কোনদিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে অত্যাচারের বিরুদ্ধে। যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন, পঁচা, সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নাম ভণ্ডামি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।” ৩১

তাঁর বিদ্রোহের কেন্দ্রবিন্দুতে সাম্যবাদ, নারীর মর্যাদা মানুষে মানুষে গড়ে ওঠা প্রেম। কোনো সচেতন শিল্পী তার সময় সমাজকে কখনো অস্বীকার করতে পারেন না। কাজী নজরুল ইসলাম তার ব্যতিক্রম নন। তিনি দেশের এমন এক সংকটময় মুহূর্তে আবির্ভূত হয়েছিলেন; যখন মুক্তি সংগ্রামের স্লোগান আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছিল। ফলে, আন্দোলন-সংগ্রামের প্রভাব পড়েছে তার কাব্যে। দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে, ভারতবর্ষের মানুষকে স্বাধীনতা উপহার দিতে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। যার হাতিয়ার হিসেবে তিনি সাম্যবাদকে তার সাহিত্য সাধনার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।

“কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি দুটোর কোনটাই নয়। আমি কেবল মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিনত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে-হাত মিলানো যদি হাতাহাতির চেয়েও অশোভন হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয় যাবে, আমার গাট-ছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোনো বেগ পেতে হবে না। কেননা, একজনের হাতে আছে লাঠি, আরেক জনের আস্তিনে আছে ছুরি। হিন্দু-মুসলমানে দিন রাত হানহানিজাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র, ঋন, অভাব, অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তুপের মত জমা হয়ে আছে। এই অসাম্য, ভেদ জ্ঞানকে দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সংগীতে, কর্মজীবনে, অভেদ-সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমি যশ চাইনা, খ্যাতি চাইনা, প্রতিষ্ঠা চাইনা, নেতৃত্ব চাইনা। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান, বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাবো নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে, সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা।” ৩২

উপরোক্ত তথ্য-উপাত্ত ও যৌক্তিক আলোচনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় প্রেম, মানবতা, দ্রোহ সবকিছুকে ছাড়িয়ে তিনি যে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক সাম্যবাদী কবি ছিলেন, তা সহজেই অনুমেয়। যদিও কিছু মানুষ অন্ধের হাতী দেখার মতো নজরুলের খণ্ডিত মতাদর্শ উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। একদল বলেছেন, নজরুল মুসলমানের কবি, আর একদল বলেছেন নজরুল হিন্দুদের কবি। প্রকৃতপক্ষে, তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূর্ত প্রতীক একজন আপাদমস্তক সাম্যের কবি। তিনি সাম্যবাদী কবি, বাঙালির প্রাণের কবি।

তথ্যসূত্র:

০১. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: শ্রীশ দাস লেন, ঢাকা, জুন ২০০৪ (কবিতা: বিদ্রোহী,পৃষ্ঠা: ০৩, লাইন ০১-০৩
০২. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: শ্রীশ দাস লেন, ঢাকা, জুন ২০০৪ (কবিতা: বিদ্রোহী,পৃষ্ঠা: ০৭, লাইন ১২৯-১৩৩
০৩.https://en-m-wikipediaorg.translate.goog/wiki/Humanism/04 April 2025/ Friday/10:30 pm
 ০৪. https://bn.wikipedia.org/wiki/04 April 2025/Friday/09:০০ pm
০৫. https://bn.wikipedia.org/wiki/04 April 2025/Friday/09:০০ pm
০৬. https://bn.wikipedia.org/wiki/04 April 2025/Friday/09:০০ pm
০৭. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: ঢাকা, জুন ২০০৪ (কবিতা: সাম্যবাদী,পৃষ্ঠা: ১৫২, লাইন ০১-১২
০৮. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: ঢাকা, জুন ২০০৪ (কবিতা: সাম্যবাদী,পৃষ্ঠা: ১৫২, লাইন ১৯-২৪
০৯. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: ঢাকা, জুন ২০০৪ (কবিতা: সাম্যবাদী,পৃষ্ঠা: ১৫২, লাইন ৩১-৩২
১০. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: ঢাকা, জুন ২০০৪ (কবিতা: সাম্য,পৃষ্ঠা: ১৬৪, লাইন ০১-০৪
১১. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: ঢাকা,, জুন ২০০৪ (কবিতা: সাম্য,পৃষ্ঠা: ১৬৪, লাইন ০৭-১২
১২. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: ঢাকা, জুন ২০০৪ (কবিতা: সাম্য,পৃষ্ঠা: ১৬৪, লাইন ১৯-২০
১৩. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: শ্রীশ দাস লেন, ঢাকা, জুন ২০০৪ (কবিতা: কুলি-মজুর,পৃষ্ঠা: ১৬৪, লাইন ০১-০৪
১৪. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: ঢাকা, জুন ২০০৪ (কবিতা: কুলি-মজুর,পৃষ্ঠা: ১৬৪, লাইন ১৪-২৩
১৫. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: ঢাকা, জুন ২০০৪ (কবিতা: মানুষ,পৃষ্ঠা: ১৫৩, লাইন ০১-০৪
১৬. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: ঢাকা, জুন ২০০৪ (কবিতা: নারী,পৃষ্ঠা: ১৬০, লাইন ০১-০৬
১৭. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: ঢাকা,, ঢাকা, জুন ২০০৪ (কবিতা: নারী,পৃষ্ঠা: ১৬০, লাইন ১৩-২০
১৮. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: ঢাকা, জুন ২০০৪ (কবিতা: নারী,পৃষ্ঠা: ১৬১, লাইন ৩৭-৪০
১৯. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: ঢাকা,, জুন ২০০৪ (কবিতা: নারী,পৃষ্ঠা: ১৬১, লাইন ৫৫-৫৮
২০. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: ঢাকা, জুন ২০০৪ (কবিতা: পাপ,পৃষ্ঠা: ১৫৬, লাইন ০১-০৪
২১. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: ঢাকা, জুন ২০০৪ (কবিতা: রাজা-প্রজা,পৃষ্ঠা: ১৬২, লাইন ০১-০৪
২২. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: ঢাকা, জুন ২০০৪ (কবিতা: কাণ্ডারী হুশিয়ার,পৃষ্ঠা: ১৯২, লাইন ১১-১৪
২৩. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: ঢাকা, জুন ২০০৪ (কবিতা: হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ,পৃষ্ঠা: ২২৯, লাইন ০১-০৬
২৪.  Dr. S Sen, Selected Poems of Percy Bysshe Shelley: New Delhi, Unique Publishers,1997 (Page: 223, Ode to the West Wind, Line: 13-14
২৪.  Dr. S Sen, Selected Poems of Percy Bysshe Shelley: New Delhi, Unique Publishers,1997 (Page: 223, Ode to the West Wind, Line: 13-14
.  Dr. S Sen, Selected Poems of Percy Bysshe Shelley: New Delhi, Unique Publishers,1997 (Page: 224, Ode to the West Wind, Line: 55-56
২৬. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: ঢাকা, জুন ২০০৪ (কবিতা: বিদ্রোহী,পৃষ্ঠা: ০৩, লাইন ১৩-২৫
২৭. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: ঢাকা, জুন ২০০৪ (কবিতা: বিদ্রোহী,পৃষ্ঠা: ১৯৭, লাইন ৬১-৬৬
২৮. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: ঢাকা, জুন ২০০৪ (কবিতা: বিদ্রোহী,পৃষ্ঠা: ৩৪৪, লাইন ১৫-৩১
২৯. কাজী নজরুল ইসলাম অভিভাষণ: যদি আর বাঁশি না বাজে;
৩০. কাজী নজরুল ইসলাম অভিভাষণ: যদি আর বাঁশি না বাজে;
৩১. কাজী নজরুল ইসলাম অভিভাষণ: যদি আর বাঁশি না বাজে;
৩২. কাজী নজরুল ইসলাম অভিভাষণ: যদি আর বাঁশি না বাজে;
 

সহায়ক গ্রন্থাবলী:
০১. কাজী নজরুল ইসলাম, সাম্যবাদী: কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা, জুন ২০২০
০২. ওসমান গনি, কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা সংগ্রহ: (ঢাকা, আগামী প্রকাশনী, ২০০৪)
০৩. Dr. S Sen, Selected Poems of Percy Bysshe Shelley: New Delhi, Unique Publishers, 1997
০৪. কাজী নজরুল ইসলাম, রুবাইয়াৎ-ই ওমর খৈয়াম: (ঢাকা, স্টুডেন্ট ওয়েজ, ১৪২৩ বঙ্গাব্দ
০৫. ড. আনোয়ারুল করিম, নজরুল: তাঁর সমকালে: (ঢাকা, নওরোজ সাহিত্য সম্ভার, ২০১৪
০৬. শাহীনুর রেজা, নজরুলের সংগীত জীবন: প্রথমা প্রকাশনী, ঢাকা ২০১২ খ্রি
০৭. রফিকুল ইসলাম, নজরুল জীবনী: কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, ঢাকা,
০৮. Winston E. Langley, Kazi Nazrul Islam: The Voice of Poetry and the Struggle for Human Wholeness: February 2009.
০৯. রফিকুল ইসলাম, কাজী নজরুল ইসলাম: জীবন ও সৃজন, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা, জুন ২০১৮
১০. সংগ্রহ সুনীল কান্তি দে, নজরুলের লাঙ্গল পত্রিকায় কৃষক-শ্রমিক প্রসঙ্গ, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা, জুন ২০১০
১১. অনীক মাহমুদ, আধুনিক বাংলা কাব্যে সাম্যবাদী চেতনা: বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯৫

(শব্দসংখ্যা: ৪৬৭৪)
This composition has copyright issue. Researchers may collect this document taking prior recommendation from the writer.

Sunday, March 30, 2025

খুলে দাও হৃদয় দুয়ার

 


খুলে দাও হৃদয় দুয়ার
ইমরুল কায়েস

যখন তুমি আমার চোখে
দৃষ্টি রেখে বলো, ‘হাতটি ধরে চলো’
তখন আমার কুঞ্জবনে মেলা
নীল ভোমরা স্বপ্নে বিভোর, পূষ্পরেণুর খেলা।

তুমি আবার ছোট্ট করে চিমটি কেটে বলো,
‘নীল ভোমরা, নীরব কেন তুমি
দূর গগনে ক্লান্ত রবি, সন্ধ্যা হয়ে এলো,
আজকে না হয় সদয় হয়ে হৃদয় দুয়ার খোলো’।

আমি তখন তোমার হাতে হাতটি রেখে চলি
দিগ্বিজয়ী বীরের মতো মিষ্টি করে বলি,
‘তুমি যদি মন কাননে নিত্য ফোটাও কলি
আজকে আমি দিবো না হয় হৃদয় দুয়ার খুলি’।

তুমি হেসে দু’হাত দিয়ে মুখটি ঢাকো লাজে
আমি তখন চঞ্চলা হই, মন বসে না কাজে
পথ ভুলে তাই হারিয়ে যাই, ডুবু ডুবু সাঁঝে
স্বপ্নমাখা বাগান বিলাস তোমার খোঁপার মাঝে।

১৬ মার্চ ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দ
০২ চৈত্র ১৪ ১৩ বঙ্গাব্দ
খুলনা

Friday, March 28, 2025

প্রেসনোট

 

প্রেসনোট
ইমরুল কায়েস

ভালোবেসে কাছে এসে যদি চাও পূর্ণ বিকেল
কোনো ক্ষতি নেই।

ভালোবেসে কাছে এসে যদি হও বিপ্লবী কমরেড
কোনো ক্ষতি নেই।

ভালোবেসে কাছে এসে যদি ধরো জীবনের হাল
কোনো ক্ষতি নেই।

ভালোবেসে কাছে এসে যদি চাও গৃহের চাবিছড়া
কোনো ক্ষতি নেই।

ভালোবেসে কাছে এসে যদি চাও লুকানো সম্পদ
কোনো ক্ষতি নেই।

ভালোবেসে কাছে এসে যদি ধরো অন্যের হাত
তো খবর আছে!

০১ জানুয়ারি ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ
১৯ পৌষ ১৪০৬ বঙ্গাব্দ
খুলনা

সেঁজুতি

 

সেঁজুতি
ইমরুল কায়েস

রাত্রি গহীন হলে মনের আকাশে তুমি
ফিরে আনো জ্যোৎস্না দোলা
আবেশে রোমাঞ্চিত হই, জেগে উঠি মায়াবীস্পর্শে।

তাতানো শরীরে তোমার কিশোরী জৌলুস
সকাল দুপুর রাত মগ্ন থাকি ফাগুন নেশায়।
নীলোৎপল নয়ন, শূভ্র পাহাড় তনু গিরিখাঁদ
মন সরোবরে তুমি একমাত্র সম্রাজ্ঞী আমার।

সেঁজুতির আলোয় আমি রাঙ্গিয়েছি ক্লান্ত জীবন
জুগিয়েছো প্রেরণা, বুকের কপাট খুলে সঁপে সব ঐশ্বর্য
তিমিরে আলোক শিখা জ্বেলে সরাবে কি জীবনের প্রহেলিকা?

১৫ জুলাই ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ
৩০ আষাঢ় ১৪১৯ বঙ্গাব্দ
খুলনা

Wednesday, March 26, 2025

এসো বৃষ্টিতে ভিজি

 

এসো বৃষ্টিতে ভিজি
ইমরুল কায়েস

আষাঢ় এলেই কেন যেন মন আনমনা হয় !
বর্ষার রিমঝিম ছন্দে, কুমারী কদম বনে হাসনাহেনা হাসে,
মৃত্তিকার সোঁদাগন্ধে ফেলে আসা দুরন্ত কৈশোর
বারবার টেনে নেয় প্রকৃতির কোলে।

আষাঢ় এলেই কেন যেন মন বৈরাগী হয় ।
দিনভর ঘনঘোর বৃষ্টিতে ভিজে যায় অচেনা দাঁড়কাক,
অগুন্তি ঘরমুখি মানুষ, পশু-পাখি, ধনক্ষেত।
মাঝে মাঝে আমিও ভিজি, ভিজতে ভীষণ ভালো লাগে।
অদ্ভুত আনন্দে দেহ-মনে শিহরণ জাগে,
নিজেকে হারিয়ে খুঁজি কৈশোরের দিনগুলোর মাঝে।

স্মৃতির সরোবরে একান্তে দিয়ে যাই পাড়ি।
আহারে আষাঢ়, ঝমঝম বৃষ্টি! আহারে কিশোর বেলা!
দুরন্ত কিশোর ছাতাহীন মাথাটাকে লুকোবে কোথায়?
স্কুলে যাওয়া-আসায় মাঝে মাঝে করুণা মিলতো;
মনে পড়ে যায়- সহপাঠিনীর ছোট্ট ছাতার নীচে
ভিজে ভিজে দু’জনে কীভাবে ফিরে যেতাম বাড়ি?

জীবনে আষাঢ় ফিরে আসে বারবার, ফিরে আসে বৃষ্টি
দিনভর বৃষ্টিতে ভিজে যায় অচেনা দাঁড়কাক, ভিজি আমিও।
দূরে থাকা সেই স্মৃতিভূক সহপাঠিনী
এখন আর বৃষ্টিতে ভেজে কি না জানি না!

২১ জুন ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দ
০৭ আষাঢ় ১৪১১ বঙ্গাব্দ
খুলনা



Friday, March 21, 2025

মধ্যরাতের চিমটি

 

মধ্যরাতের চিমটিি
ইমরুল কায়েস

মিষ্টি মেয়ে কেমন আছো?
ফেলে আসা দিনগুলো কি মনে পড়ে?

আমার এখন ব্যস্ত সকাল, দগ্ধ দুপুর, ক্লান্ত বিকেল, সন্ধ্যাবেলা
রাত্রি নামে আঁধার দোলায়, পাই না সময়
কেউ বলে না ভালোবাসার প্রজাপতির কেমন করে কাটছে বেলা।

মধ্যরাতে সবাই ঘুমায় নির্ভাবনায়
আমি একা ব্যথার নীলে কলম চষি
ক্লান্ত মগজ, ক্লান্ত কলম, পিটু্ইটারি বিকল যখন
ছোট্ট করে চিমটি কাটো স্মৃতির গায়ে তুমি তখন।

২৫ অক্টোবর ২০১২ খ্রিষ্টাব্দ
১০ কার্তিক ১৪১৯ বঙ্গাব্দ
খুলনা

আমি মৌ, তুমি মৌবনে ফুল

 

আমি মৌ, তুমি মৌবনে ফুল
ইমরুল কায়েস

ভেবেছি স্রোতস্বিনী নবগঙ্গা তীরে বাঁধবো ঘর
তোমাকে নিয়ে নিশ্চিন্তে সাজাবো সংসার
সারাদিন ফসলের ঘ্রাণ শুঁকে
সন্ধ্যার মলিন আলোয় দু’জনেই বাহুডোরে পড়বো বাঁধা,
এক ফাঁলি নরম রোদ্দুর ভোরে পরশ বুলাবে গায়।

বিদূষী নবগঙ্গার শীতল জলে ধুঁয়ে সব নীল অঙ্গার
সন্ধ্যার আলো মেখে ফিরে আসবো নীড়ে।

সরিষার ফুল ছিঁড়ে বানাবো অলঙ্কার তোমার নাকে কানে
উড়িয়ে মায়াবী চুল তুমি ছুটে যাবে মৌ মায়াটানে

আমি হবো মৌ, তুমি মৌবনে হবে ফুল
আমাদের নীড় ভরে যাবে গানে গানে।

১৯ অক্টোবর ২০০৭ খ্রিস্টাব্দ
০৪ কার্তিক ১৪১৪ বঙ্গাব্দ
খুলনা

Thursday, March 20, 2025

প্রভাষিকা ০১


প্রভাষিকা ০১
ইমরুল কায়েস

বুকের ভিতোর  গরান কাঠের আগুন জ্বেলে
তুমি এখন বাইশ মাইল দূরে থাকো
অগ্নিশিখা দহন করে আমার শরীর
হৃদপিণ্ডে তবু তুমি মাঝে মধ্যেই চিমটি কাটো।

আমি এখন মধ্যরাতে কলম চষি
তুমি ঘুমাও নির্ভাবনায় বাহুডোরে
মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে চমকে উঠি
জাগি তোমার গৃহকাঁপা শীৎকারে।

শ্রেণি কক্ষে কবির লেখা কাব্য বোঝাও,
বোঝো কি তার গুঢ় অর্থ, মর্মকথা?
বুঝলে কি আর বাইশ মাইল দূরে থাকো
চিতার আগুন জ্বালার কি হয় স্বার্থকতা।

তুমি এখন ফুলতলাতে ভালোই আছো
নিত্য-নতুন স্বপ্ন তোমার ছড়াছড়ি,
স্মৃতিগুলো বস্তা ভরে আগুন জ্বেলে
আমিও এখন ভালো থাকার চেষ্টা করি।

২১ জুলাই ২০১১ খ্রিস্টাব্দ
০৫ শ্রাবণ ১৪১৮ বঙ্গাব্দ
খুলনা

প্রভাষিকা ০২

 

প্রভাষিকা ০২
ইমরুল কায়েস

খা খা চৈত্র, তপ্ত দুপুর, ব্যস্ত নূপুর, কাঁকনপরা হাত
নগ্ন নেশায় হাতছানি দেয় প্রিজারভেটিভ ভালোবাসা।

নাবিকের নৌযানে পাল তুলে ভেসে যায় প্রভাষিকা
হিমেল হাওয়ায় সুখের দোলায় দোলে জলাঙ্গির ঢেউ
দগ্ধ কবি শুধুই কবিতা লেখে অর্থ বোঝে না কেউ।

আকাশের সামিয়ানা কবির কষ্টে হলো নীল
কবিতার সাথে তবু প্রভাষিকার হলো না পরিচয়,
তালহারা জীবনে কবি এখন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান কিছুই চায় না
রঙমহলে নেশার শারাব, ছেঁড়া ছেঁড়া ব্যথার পঙক্তিমালা।

২৩ আগস্ট ২০০৫ খ্রিস্টাব্দ
০৮ ভাদ্র ১৪১২ বঙ্গাব্দ
খুলনা


Wednesday, March 19, 2025

অবুঝ রাখাল ও তার রক্তাক্ত স্বপ্ন

অবুঝ রাখাল ও তার রক্তাক্ত স্বপ্ন
ইমরুল কায়েস

এক স্বচ্ছল মধ্যবিত্তের বাড়ির আঙিনায় 
অনেক যত্নে গড়ে ওঠেছিল একটি ছোট্ট ফুল বাগান
দীর্ঘ সাক্ষাৎকার শেষে সেই বাগানের মালির দায়িত্ব 
দেওয়া হয় এক স্বপ্ন বিলাসী রাখালের উপর।
রাখাল মালির অক্লান্ত শ্রম আর তিল তিল ভালোবাসায়
দ্রুত বড় হয়ে উঠলো চারাগাছ।

বসন্তের প্রথম প্রহরে সেই চারাগাছে ফুটলো ফুল
ফুলের বর্ণে-গন্ধে-সৌন্দর্যে রাখাল হয়ে উঠলো ব্যাকুল।

মাঝে মাঝে সবার অজান্তে ফুলের ঘ্রাণ শুকতো সে
মালির উষ্ণ নিঃশ্বাসে দুলে উঠতো ফুলের কুমারী দেহ-মন
নির্জনে, নিঃসঙ্কোচে সেও মেলে দিত পাপড়ি।

একদিন এক অবাঞ্চিত দুঃসাহস বুকে নিয়ে
বাগানের মালিকের কাছে অবুঝ মালি চেয়ে বসলো-
সর্ব কনিষ্ঠ ও সুদৃশ্য, মায়াময় মোহনীয় ফুলটি।

মুহূর্তে রক্তাক্ত হলো রাখাল মালির অবুঝ স্বপ্ন।
চিরকালের জন্য তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হলো
মোহনীয় সেই  সুদৃশ্য ফুল ছোঁয়ার নিঃষ্পাপ অধিকার।

২৩ আগস্ট ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দ
০৮ ভাদ্র ১৪১০ বঙ্গাব্দ
খুলনা।

 

Saturday, March 15, 2025

Biography of Poet Imrul Kayes

 

ইমরুল কায়েস 

Biography of Poet Imrul Kayes
Imrul Kayes was born on 1st January 1979 at Magura in the parental care of Md. Sirazul Islam and Halima Begum. He spends his childhood and boyhood in his native surroundings and left for Khulna, the third largest city of Bangladesh in 1993 for higher education. He has achieved his graduation and post graduation degree in English and now he holds the position of the Principal of Islamabad Collegiate School Khulna; a college of Khulna City Corporation.
 
He has been writing poems and songs since his boyhood. His eleven books, mostly poetry written in Bengali, have been published yet and his fame of a phenomenal poetic genius is well-known to all. The Verses of Tranquility which contains a total of fifty two English poems is his ninth publication. The poet deliberately deals with the theme of patriotism and love, characterized by both physical nature and eternality that exhibit a wonderful fusion of life and nature in his verses. His remarkable quality for becoming a poet is his profuse use of lyricism. Though his verses are modern in nature, they bear wonderful lyrical grace and a kind of rhythmic movement which has contributed to his poems a unique spontaneity.
 
The poet has an active participation with Bangladesh Television, Bangladesh Betar, Zella Shilpokala Academy, Khulna Shishu Hospital, Khulna Cultural Center, Khulna Sahitya Majlish, Magura, Family Planning Association of Bangladesh etc.

He has composed near about one thousand songs which have already tuned in Bangladesh Betar & Bangladesh Television. His songs and dramas have got much popularity among the people of both Bangladesh & West Bengal. He manages a YouTube Channel named Imrul Kayes Lyrical & a Literary Blog named Imrul Kayes Art Gallery.
 
His active involvement in social and cultural welfare and his work of educating the young pupils has made his literary career colorful and dignified.

At present, he is serving the nation as the Principal of Islamabad Collegiate School Khulna, an institution of Khulna City Corporation and living with a tiny happy family at Khulna city in Bangladesh. 

The Publications of Imrul Kayes:

Poetry: Bhalobashar Janmodine/Publisher:Khulna Sahitya Majlish/2003/Khulna
Poetry: Amar Jadi Thkto Dana/Publisher:Khulna Sahitya Majlish/2010/Khulna
Poetry: Chetonar Ful/Publisher:Khulna Sahitya Majlish/2011/Khulna
Lyrical Poetry: Geeti Shotodall/Publisher:Khulna Sahitya Majlish/2012/Khulna
Poetry: Mayabi Sandyar Awvan/Publisher:Khulna Sahitya Majlish/2014/Khulna

English Publication:
Thesis Work: R.K. Narayan's Raju: Guiding, Misguiding and Misguided/ Khulna Cultural Ceter/2014/Khulna
English Poetry: The Verses of Tranquility/Publisher:Kobi Prokasoni/2019/Dhaka

Poetry; Neel Prajapati/Publisher:Khulna Cultural Ceter/2016/Khulna
Lyrical Poetry: Kathar Parag/Publisher:Khulna Cultural Ceter/2018/Khulna
Poetry: Amar Prithibi/Publisher:Khulna Cultural Ceter/2021/Khulna
Poetry: Rubaiyat e Imrul Kayes/Publisher:Khulna Cultural Ceter/2025/Khulna (Yet to be Published)

Social Links:
https://www.youtube.com/@imrulkayeslyrical2598
https://imrulkayesartgallery.blogspot.com/
https://www.facebook.com/ImrulKayesAuthor

 



Shireen Abu Akleh

 

Shireen Abu Akleh
Imrul Kayes

How can we forget you, Shireen?
You were an Arabian harbinger.
A true voice of humanity, a clear protest from Jenin.
 
How can a bullet do remove your name from our minds;
From the history of humanistic journalism?
When you present the untold miseries of Palestine?
 
Your body was wrapped in the Palestine flag.
Your coffin was cladded in red
Thousands of Palestinians mourned for you with wet eyes.
Their outrages, cries and prayers made the procession dignified.
Your heroism made the world speechless;
Wafting like a snowy steam along the pale palm trees.
 
Your mighty pen and sharp lens
Told the untold story of Gaza, Jenin and Jerusalem
Was that the only fault you commit?
How unjust you received for your land and your profession?
Your sacrifice will tell the tale of Palestine.
 
Wake up, wake up the sleepy Arabians
Wake up to lay down the lives for homeland
And to get the right of your land.
She should be the last to pay.
 
Shireen Abu Akleh must be remembered
By the uncounted sorrowful faces now and the generation upcoming.
Shireen, you will live in our heart eternally.

20 May 2022
Khulna, Bangladesh.

Note: Shireen Abu Akleh was a journalist worked in Al Jazeera who was slain by Israeli solders in Jenin, Palestine while covering a crucial news for her channel. She was born in Jerusalem in 03 April 1971.


Friday, March 14, 2025

ইমরুল কায়েস এর রুবাই (৮১-১০০)


ইমরুল কায়েস এর রুবাই
রুবাই ৮১:
মনের মাঝে কা’বা শরীফ চোখের তারায় মদিনা
তোমার ধ্যাণে মগ্ন থেকে রোজ নেকী চাই বদি না
আলোর পথের যাত্রি আমি আলো খুঁজি আন্ধারে
তোমার ক্ষমায় সিক্ত করে পার করো এ বান্দারে।

রুবাই ৮২:
আর ডেকো না সুনয়না মধ্যরাতে তুমি আমায়
তোমার আমার গোপন প্রণয় রাষ্ট্র হবে পাড়ায় পাড়ায়
রক্তচক্ষু লোকলজ্জ্বায় তোমার পরশ যদি না পাই
নীল সাগরে মরবো ডুবে ব্যর্থ প্রেমের দহন জ্বালায়।

রুবাই ৮৩:
বোধি বৃক্ষ, হেরা গুহা আমার কিন্তু কোনোটাই নাই
তবু আমি তোমার ধ্যানে মগ্ন থাকার সুযোগ চাই
জানি আমার জিন্দেগীতে সঙ্গী শুধু ব্যস্ততা
দিনের শেষে জিন্দেগীতে তোমার আশীষ যেন পাই।


 

ইমরুল কায়েস এর রুবাই (৬১-৮০)

 


ইমরুল কায়েস এর রুবাই
রুবাই ৬১:
এক পেয়ালা শারাব দিও একটি দিও পানের খিলি
মিষ্টি ভালোবাসার সাথে জল-তরঙ্গ ঝিলিমিলি
গোলাপ রাঙা কপোল জুড়ে আঁকলে চুমোর আল্পনা
বলতে পারবে তোমার আমার ভালোবাসা গল্প না।

রুবাই ৬২:
চাইলে তুমি ভাবতে পারো করতে পারো সময় ক্ষেপন
আমি কিন্তু কলঙ্কের দাগ খ্যাতির পালে করছি লেপন
তোমায় ছাড়া বেঁচে থাকার অন্য কোনো উপায় কোথায়?
অক্সিজেনের সিলিন্ডারটা অন্য কাউকে দিতে চাই না।

রুবাই ৬৩: 
অভিনয়ে দক্ষ তুমি সহজে তাই টলবে না
মুখে বলো মিষ্টি কথায় শুকনো চিড়ে গলবে না
আমি কিন্তু ভাবনা ছাড়াই দিচ্ছি বলে ইচ্ছেটা
তোমায় ছাড়া জীবন আমার এক মুহূর্তও চলবে না।

রুবাই ৬৪:
এখন থেকে মৃত্যু অবধি সখি তুমি শুধুই আমার
মরার পরে জীবন পেলে সে জীবনেও তুমি আমার
এই অবস্থা আমার যখন তোমার ভাবার সুযোগ কোথায়?
কোথায় সুযোগ হ্যাঁ না বলার যখন আমি শুধুই তোমার।

রুবাই ৬৫:
বাল্যকালে আমার সাথে প্রজাপতি করতো খেলা
কেউ জানে না প্রজাপতির এখন কেমন কাটছে বেলা
আমার এখন ব্যস্ত সকাল, তপ্ত দুপুর, পাই না সময়
মনে পড়ে কেমন করে করছি তারে অবহেলা।





:


চেতনায় কাজী নজরুল

  চেতনায় কাজী নজরুল ইমরুল কায়েস হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর, মানুষের মননে মননে বিদ্রোহের ঝঙ্কার তুলে কাঁপিয়ে দিয়েছিল যে আলোক বিচ্ছুরিত ক্ষণজন্...