Friday, September 13, 2024

কাবেদুল ইসলাম

 

কাবেদুল ইসলাম এর কবিতায় প্রকৃতি
ই ম রু ল কা য়ে স
"সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি"০১ - কবি জীবনানন্দ দাশের এই প্রমিত সুন্দর শিল্পতত্বের নিরিখে কবি ও কবিতার মানদণ্ড নিরুপন করা বড়ই দুরুহ। মোটা কথায় বলতে গেলে, যারা কবিতা লেখেন তাদেরকে আমরা ‘কবি’ বলে থাকি, আর একজন কবি সাধারণতঃ যা লিখে থাকেন তাই ‘কবিতা’। কিন্তু একজন কবির লেখা ছন্দোময় মনোমুগ্ধকর রসাত্মক পঙক্তিমালা কবিতার শিল্পগুণ বিচারে কতোটা উত্তীর্ণ কিম্বা কবিতার লেখক তার শিল্পসত্ত্বার বিচারে কতোটা পারঙ্গম তা নিয়ে ঢের বিতর্ক হতে পারে।
"কে যেন ভিতোর থেকে আমাকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নেয়।"০২ কবি কাবেদুল ইসলাম তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ তোমার জন্যে কবিতার ভূমিকায় নিজেই স্বীকার করেছেন এই কবিতার গুঢ়তত্ত্ব। কবিতা সম্পর্কে কবির একান্ত ব্যক্তিগত ও অকপট এই উচ্চারণ কবিতার অর্থ ও চরিত্র নির্ধারণে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ - এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। একই পরম্পরায় তিনি বলেছেন-
“... কবিতা বলতে আমি বুঝি স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ, উজ্জ্বল, দৃঢ় এক জীবনসত্যের মহৎ মন্ত্রোচ্চারণ, যা কবির রক্ত ও স্বেদ, হৃদয় ও মনন, অভিজ্ঞতা ও বোধি থেকে উৎজাত। ফলে কবিতা যা বলেন, তা মূলতঃ কবির মননে-মানসে ও জীবনচর্চায় পূর্বেই আলোড়িত, চর্চিত, প্রতিফলিত। এই অর্থে আমার কাছে কবিতা তাই-ই যা জীবন, তা-ই জীবন যা কবিতা।” ০৩
মূলতঃ কবিতা হলো শব্দে ও ছন্দে আবেগের স্বতঃস্ফুর্ত বহিঃপ্রকাশ; ছন্দেময় রসসিক্ত পঙক্তিমালা। সাহিত্যের সবচেয়ে ঘন, জীবনসম্পৃক্ত, শিল্পসমৃদ্ধ ও রসাত্মক শিল্পবিভাজনের সবচেয়ে জনপ্রিয় নামটিই কবিতা। কবিতার ফেরিওয়ালা কাবেদুল ইসলামও একজন কবি; মূলতঃ রোমান্টিক কবি। আধুনিকতা ও রোমান্টিকতার সমন্বিত যোগসূত্রে, যুগল স্রোততরঙ্গে তিনি তার কবিতায় লাগিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন মাধূর্যের প্রলেপ। বলাবাহুল্য, প্রেম ও প্রকৃতি সেখানে শক্তিশালী ও অপরিহার্য এবং এক অপরের সম্পুরক অনুষঙ্গ।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘সাহিত্যের পথে’ প্রবন্ধে লিখেছেন- “আধুনিকতা হলো প্রবাহমান নদীর সুস্পষ্ট শেষবাঁক।”০৪ আমাদের সাহিত্যের চিরন্তন প্রবাহমানতায় কাবেদুল ইসলামের কবিতাও রয়ে যাবে স্বমহিমায়। প্রবাহমান স্রোতস্বিনীর সুস্পষ্ট বাঁক অতিক্রম করে আধুনিকতার সিঁড়িতে তার কবিতার শিল্পাসন কোথায় হবে সেটা গবেষণার বিষয়। কিন্তু আজকের প্রসঙ্গ ভিন্ন; বিশেষ লক্ষ্য অভিমুখে সত্য উৎঘাটনের শৈল্পিক অন্বেষণ ছাড়া আমাদের বাইরে পরিক্রমণের সুযোগ নেই।
বলাবাহুল্য, শিরোনামের মধ্যেই স্পষ্ট রয়েছে আমাদের আজকের প্রসঙ্গ; ‘কাবেদুল ইসলামের কবিতায় প্রকৃতি’। লক্ষ্যের শেষপ্রান্তে পৌঁছতে আমাদেরকে অবশ্যই কয়েকটি শব্দ; যেমন প্রকৃতি, কবি ও কবিতা, কাবেদুল ইসলামের কবিসত্বা ও তার কবিতার স্বরুপ বিশ্লেষণ করা দরকার।
কবি কাবেদুল ইসলামের জন্ম খুলনা শহরে। শৈশব ও কৈশোরের বিচরণক্ষেত্র এই শহরের ফেরিঘাট, শেখপাড়া, তারের পকুর ও বানরগাঁতী এলাকা। বাবা শেখ জোয়াদ আলী এবং মা আনোয়ারা আলীর মধ্যবিত্ত¡ সংসারে তিনি তৃতীয় সন্তান। সঙ্গতকারণে তার লেখালেখিতে মধ্যবিত্ত; ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন, সংসারের ভিতোর ও বাহিরের পরিবেশ-প্রতিবেশ, মানবপ্রেম, প্রেমের গতিপথে গেঁথে থাকা চিরন্তন প্রতিবন্ধকতা, বিরহ, মননস্পর্শিত সমসাময়িক বিষয়াবলী, দ্রোহ, মিলন ও সাম্যবাদের অনুরণন এবং প্রকৃতি ও প্রাকৃতজ উপাদান অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। স্পষ্টতঃ আমাদের আজকের অনুষঙ্গ তার কবিতা; প্রকৃতি কীভাবে তার কবিমানসকে সংক্রমিত করেছে; কীভাবে তার সংক্রমিত অন্তর্জগৎ ও কবিতার শরীর বিনির্মাণে প্রকৃতি অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে তার স্বরুপ বিশ্লেষণ করা।
এক.
‘নৈশব্দের কালবেলা’; কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশকাল: মে ১৯৮৭ খ্রি.। প্রকাশক শেখ আবদুল কাদের। খুলনা থেকে প্রকাশিত।
কবির অন্তর্জগত নিঃসৃত, প্রগাঢ় বিরহমিশ্রিত নৈরাশ্যবোধ ও মিলনের সুতীব্র অগ্নিআকাঙ্ক্ষার তুমুল বজ্জ্রবৃষ্টিপাত এই গ্রন্থখানির কবিতার শারীরিক অবয়বকে করেছে মহিমান্বিত। স্বতঃস্ফুর্ত আবেগের অকপট ও সাবলীল বহিঃপ্রকাশ কবির কবিসত্ত্বাকে দিযেছে নিজস্বতা; স্বতন্ত্র রচনাশৈলী ও ব্যক্তিনির্মিত উপমার ছড়াছড়িতে গ্রন্থখানি অনন্য।
‘নীলার কাছে শেষ চিঠি’ কবিতাটি কবির সীমাহীন বিরহবোধ ও নিসঃঙ্গতার পোড়াকষ্টের ধোয়ায় আচ্ছন্ন। শরৎচন্দ্রের দেবদাসের মতো উদাসীন, ভাবলেশহীন ও বিষন্নতাভরা এক জীবনের খণ্ডচিত্র প্রকাশ পেয়েছে কবিচরিত্রে। নীলাকে সম্বোধন করে কবির অনুযোগ-
“দূরে সবুজাভ লোকালয়, গাছ্গাছালির মায়া,
আমরা এখানে নিরালায় দু’জনে একান্ত পাশে,
আদি মানবী তুমি আবক্ষ নগ্ন, ঘাসে গেছ মিশে,
আমি নিঃশ্বাসে তোমার ঘিরে আছি বুনো কায়া।
সেই ঝিল- টলটলে জল-কাকের গভীর চোখ,
ওপাশে কড়ুই শাখে সিক্ত শিশিরে পাখির বাসা,
ঘাসের হলুদ ফুলে ফড়িংগুলো জড়াজড়ি করে,” ০৭
কবির কাছে প্রকৃতি মানে অফুরন্ত প্রশান্তির সরোবর। নৈসর্গিক প্রশান্তির কাছে কবির বারবার ফিরে যাওয়া, বারবার কাছে যাওয়া এবং চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের ফলে কবিতার শব্দচয়নে যুক্ত হয়েছে গাছগাছালি, সবুজাভ লোকালয়, সবুজ ঘাস, বুনো কায়া, ঝিল- টলটলে জল, কাকের গভীর চোখ, কড়ুই শাখা, শিশির, পাখির বাসা, ঘাসের হলুদ ফুল, ঘাসফড়িং ইত্যাদি শব্দসমুহ। এই শব্দসমুহের ব্যবহার কবিতার শরীরে খুবই সাবলীল ও অপরিহার্য; কোনো একটি শব্দকে সরিয়ে নিলে খসে পড়বে কবিতার সমগ্র শরীরপ্রাসাদ।
‘কবেকার প্রাচীন অসুখ’ কবিতায় কবি এক ধরণের মানবিক অসুখে ভোগার কথা উল্লেখ করেছেন। শরীরের ভিতোর অসুখের বিস্তারের সাথে কবি বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা বিস্তারের বিষয়টি উপমিত করেছেন। ইংরেজ কবি Robert Frost তার ‘Tree at My Window’ কবিতায় জানালার পাশে থাকা গাছটির সাথে তার নিজের জীবনের রূঢ় অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেছেন- “Your head is too much concerned with outer,/Mine with inner, weather.” 08 একইভাবে, কবি কাবেদুল ইসলামও নিঃস্ব প্রবীণ বৃক্ষের সাথে তার ব্যক্তি জীবনের কষ্টের অনুভূতি ভাগাভাগি করেছেন-
“এই শ্রাবণের ঝরঝর বৃষ্টিত চিত্রল দিন
এই অনিঃশেষ বেদনার একাকী নিঃসঙ্গ রাত,
হিমদীর্ণ অন্ধকার ক্লান্তিতে শীর্ণ নিঃস্ব প্রবীণ
বৃক্ষের মতো, আমি তো পারি না আর সুঅভিজাত
ক্ষয়রোগ নিয়ে বেঁচে থাকতে, আর কতো বসন্ত
নিঃষ্ফল হবে? সুদীর্ঘ পথ হেঁটে আমি বড়ো ক্লান্ত।” ০৯
দুই.
তোমার জন্যে কবিতা; কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশকাল: জুলাই ১৯৯১ খ্রি.। প্রকাশনা: কথকথা প্রকাশনী। স্থান: বগুড়া।
কবিতার শিল্পগুণ বিচারে, এযাবত প্রকাশিত কবিতার মধ্যে কবির সবচেয়ে মানোত্তীর্ণ এবং সবচেয়ে আবেগময় শক্তিশালী কবিতার বসতি এই কাব্যগ্রন্থে।
এই গ্রন্থের অন্যতম কবিতা- ‘গন্তব্য এখন। তখনকার নোংরা সমাজ, দুঃখী লোকালয় ও চারপাশের মানুষের হিংসা-দ্বেষ কবির অন্তর্জগতকে ভীষণভাবে ব্যথিত করে। চরম নৈরাশ্যবোধের ভাবনা থেকে তিনি মুক্তি পেতে চান; সর্বস্ব বিকিয়ে কবি প্রকৃতির কোলে আশ্রয় পেতে চান। প্রকৃতিআশ্রিত কবির আকুতি-
`এখন ইচ্ছে করে চ’লে যাই সুদূর কোনো কোলাহলহীন দ্বীপে
চারিদিকে যার আকাশ-নীলিমা, সমুদ্রের জলের প্রহার
সুগন্ধ জড়ানো সবুজ বাতাস যেনো শুয়ে আছে
প্রতীক্ষায় উপোষী রমণীর যুগল প্রজাপতির চোখের ভিতোর’১০
এখানে, প্রকৃতিকে কবি মানসিক যন্ত্রণার গ্রাস থেকে আত্মত্রাণের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যেভাবে, একইসুরে ইংরেজ কবি William Wordsworth তার ‘Tintern Abbey’ কবিতায় ব্যক্ত করেছেন- “Nature never did betray/The heart that loved her…” 11
একইভাবে, ‘অনাগত শিশুর প্রতি’- কবিতায় কবি ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের প্রতি বিষোদগার করেছেন। একটি স্বপ্নময় সমাজ বিনির্মাণের প্রত্যাশা করে কবি তার অনাগত শিশুর প্রতি আহ্বান রেখেছেন-
‘তুমি আসছো, বাংলাদেশ নামের একদা উজ্জ্বল সবুজ এক ভূখণ্ডে
তুমি আসছো এখানে
একদা যেখানে ছিল
পাখির ছোট বুকের মতো নরম সবুজ ঘাস
চোখের সামনে খোলা আকাশ, কয়েকটা চিল, কবুতর
অজানা বুনো ফুলের মতো নদীর জলের নোনা গন্ধ’১২
এখানে, প্রেমিকাসদৃশ প্রকৃতির অবক্ষয়ে কবির প্রেমসত্ত্বা দারুণভাবে মর্মাহত হয়েছে। ইংরেজ কবি পার্সি বিশি শেলীর মতো তিনিও প্রথাগত, ক্ষয়ে যাওয়া সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে নতুন এক সম্ভাবনাময় সমাজ ব্যবস্থা বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছেন।
‘তোমার জন্যে কবিতা’- কবিতাটির শিরোনামকেই এই গ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছে। এই কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্যময়তায় কবির সপ্রশংস মুগ্ধতা প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু, তাবৎ মুগ্ধতা দু’হাতে সরিয়ে, পিছনে ফেলে, প্রেমিকার শুভ্র শরীর সরোবরে তিনি নিমেষেই ডুবে যেতে পারেন। কবির অকপট স্বীকারোক্তি-
“চিলেকোঠার ঘুলঘুলিতে রোদ,
কার্ণিশে শর্সে ফুলের মতো হলুদ চড়ুই
রমণীর সিঁথির মতো দূরের পিঙ্গল নদী
এসব কিছু ছেড়ে চ’লে যেতে পারি যদি তোমাকে পাওয়ার
এতোটুকু নিশ্চয়তা পাই।”১৩
কবি অকপটে ঘোষণা করেছেন “এই পৃথিবী শুধুমাত্র তাদের জন্য এবং পাখি ও প্রজাপতির জন্য। হরিণীদের জন্য অরণ্য, হৃদয়ের জন্য প্রেম এবং বৃষ্টির জন্য মৃত্তিকা।” ফলে, কবি, প্রকৃতি ও প্রেমিকা এই কবিতার ত্রিমাত্রিক অপরিহার্য অনুষঙ্গ।
‘পৃথিবী জোড়া বৃষ্ঠিতে’ বৃষ্টির সাথে কবির আজন্মের আত্মীয়তার সম্পর্ক প্রকাশ পেয়েছে। বৃষ্টির মাধ্যমে প্রকৃতি জীবন ফিরে পায়, পরিশুদ্ধতা আসে। জীবনের পরিশুদ্ধতা আনয়ণে কবি তার প্রেমিকাকে আহ্বান করেছেন-
“অতএব অভিমানী নারী, উত্তর জানালা খুলে দাও
কার্ণিসের উপর পড়ুক তুমুল বৃষ্টিপাত
দুধের সরের মতো বৃষ্টি বিষন্ন পৃথিবী জুড়ে থৈ থৈ
ভেসে যাক মাঠঘাট আর বাড়ীঘর অনন্তের জলের খেয়ায়
ভেসে যাক সোনালি গমের ক্ষেত, নিশ্চুপ অন্ধকার অলক্ষ্যে
ধুঁয়ে যাক নর আর নারীদের হৃদয়ের শরীরের পাপ” ১৪
তিন.
অলৌকিক সনেটগুচ্ছে; কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশকাল: জুন ২০০২ খ্রিস্টাব্দ। প্রকাশনা: কথকথা প্রকাশনী। স্থান: খুলনা। ব্যাক কভারে কবির জীবনী বর্ণনায় গ্রন্থের প্রকাশিকা পারভীন ইসলাম শিমুর (যিনি কবির সহধর্মিনী) সরল স্বীকারোক্তি-
“... স্বভবতই এ অঞ্চলের(খুলনাঞ্চলের) নিবিড় সবুজ প্রকৃতি, শস্যশ্যামল ক্ষেত্র, পানের বরোজ, জলবন্দি জনপদ, ধুসর জোয়ারের নদী, অন্ধকার ঝোপঝাড়, বাঁশবনে নিশিরাতের জোছনা-- সবকিছুই তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। অনিবার্যভাবে এসব তাঁর কবিতায় সুচারুরূপে ফুটে উঠেছে।” ১৫
‘ফিরে চাই বাউড়ি বাতাস’ শিরোনামের সনেটে প্রকৃতির সাথে কবির লেপ্টে থাকা জীবনের আটপৌরে সম্পর্কের শাব্দিক চিত্রকল্প স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। যেখানে কবির পিছনে পড়ে আছে-
‘‘... চিহ্নহীন জনপদ।
কাক-মরা গ্রাম, চষাক্ষেত, শস্যের শূণ্য বসন,
কাল স্রোতস্বিনী পদ্মার নিরিবিলি বয়েসী ভাঙন;
... গাঢ় সবুজ টেনে নিয়ে যায় কাছাকাছি
অরণ্যের মধ্যিখানে। গৃহস্থের নিকোনো উঠোন,
লাউডগা ঝুলে থাকে, বনরাজিনীলা গৃহকোণ;
সেই সব শূণ্যতায় বড়বেশী জীর্ণ হয়ে আছি। ” ১৬
প্রকৃতির সাথে কবির অছেদ্য সম্পর্কের কারণে তিনি প্রকৃতির কাছেই চেয়েছেন বেঁচে থাকার অনুষঙ্গ, মৃত্যুর কাছাকাছি যাওয়ার শক্তি এবং সেখান থেকে ফিরে আসার মূলমন্ত্র-
“আবারও জাহাজের পালে চাই বাউড়ি বাতাস
ক্ষিপ্রগামী গাংচিল, মুখোমুখি নদী খোলামেলা,
হাঙরের অন্ধকার অস্থির স্তুপ, পুরোনা মাস,
অনুকূল নোনাপানি। সমুদ্রের গহিন সুরেলা
ডাক নিয়ে যাবে মৃত্যু আর জীবনের কাছে ফের,
শেখাবে যুদ্ধ, মৃত্যুতে বাঁচার মন্ত্র ঢের।” ১৭
জীবন মানেই মৃত্যু অনিবার্য - এই চিরন্তন সত্যটুকু কবি তার প্রিয়তমাকে স্মরণ করিয়ে মিলনের অভিলাষ ব্যক্ত করেছেন। মানবপ্রেম ও প্রকৃতিপ্রেমের সাথে সুস্পষ্ট যোগসূত্র নির্মিত হয়েছে এই কবিতায়, যেখানে জীবনের সাথে বিচ্ছেদ মানেই চিরচেনা পরিবেশ-প্রতিবেশ ও প্রকৃতির সাথে চূড়ান্ত ছাড়াছাড়ি। আবহমান সনেটের অষ্টকে তিনি ‘ছেড়ে যাবো’ মানে জীবনের সাথে লেপ্টে থাকা পারিপার্শিকতার বাহুবন্ধন থেকে হারিয়ে যাবেন বোঝাতে চেয়েছেন-
“একদিন নিশ্চয়ই ছেড়ে যাবো এই রূপবতী
দেশ, সোনালি শস্যের ক্ষেত, বনভূমি, গাছপালা,
মানুষের চেনাজানা গৃহস্থালি, উঠোন, গো-শালা,
প্রিয়তম স্বজনের গহিন কালো চোখের জ্যোতি।
শ্রাবণের কাজল বর্ষা, জলবতী মেঘের পাহাড়,
সারাদিন রিমঝিম আশ্চর্য ভেজাবে পথঘাট, ”১৮
‘সারেং, চলো ফিরে যাই’ কবিতায় জীবনের সওদা নিয়ে বন্দরে বন্দরে নোঙ্গর ফেলা সারেং গৃহের টানে ভীষণ কাতর। প্রাণে প্রাণে ভালোবাসার সওদা ফেরি করা কবিও একসময় জাহাজের সারেং এর মতো চরম ব্যাকুলতা অনুভব করেন; ফিরে যেতে চায় আপন নীড়ে- উত্তর থেকে দক্ষিণে, আরো দক্ষিণে-
“... যেখানে গৃহস্থের নিকোনো উঠোন
শিমের মাচান, লাউডগা, সুপোরির কালো বন,
লাল-পেড়ে শাড়িপরা বধূ রস জানালায় উনুনে;
সোঁদাগন্ধ মাটি, কলমির বুকের নওলা ‘ওম’,
ডাহুকের ডাক, কোড়া কালিমের ছানা, বক, লোম-
ওঠা কুকুরের-শেয়ালের হল্লা, ভোরের স্নিগ্ধতা।” ১৯
তথ্যসুত্র:
০১. জীবনান্দ দাশ/কবিতার কথা, পৃষ্ঠা: ১০, লাইন: ০১
০২. কাবেদুল ইসলাম/তোমার জন্যে কবিতা, ভূমিকা: লাইন ০২-০৩
০৩. কাবেদুল ইসলাম/তোমার জন্যে কবিতা, ভূমিকা: লাইন ১৭-২১
০৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/সাহিত্যের পথে, পৃষ্ঠা: ৪৮, লাইন: ?
০৫. কাবেদুল ইসলাম/নৈঃশব্দের কালবেলা, লাইন: ২৭-৩১
০৬. কাবেদুল ইসলাম/নৈঃশব্দের কালবেলা, লাইন: ৩৫-৩৮
০৭. কাবেদুল ইসলাম/নৈঃশব্দের কালবেলা, লাইন: ০৫-১১
০৮. Robert Frost/Tree at My Window, Line: 15-16
০৯. কাবেদুল ইসলাম/নৈঃশব্দের কালবেলা: লাইন: ০৯-১৪
১০. তোমার জন্যে কবিতা, গন্তব্য এখন, লাইন: ১৭-২০
১১. William Wordsworth/Tintern Abbey, Line: 15-16
১২. তোমার জন্যে কবিতা, অনাগত শিশুর প্রতি, লাইন: ০২-০৭
১৩. Percy Bysshe Shelley/Ode to the West Wind
১৪. তোমার জন্যে কবিতা, তোমার জন্যে কবিতা, লাইন: ০৫-০৯
১৫. তোমার জন্যে কবিতা, পৃথিবী জোড়া বৃষ্টি, লাইন ০৯-১৪
১৬. কাবেদুল ইসলাম/অলৌকিক সনেটগুচ্ছ, কবি-পরিচিতি: লাইন ০২-০৫
১৭. অলৌকিক সনেটগুচ্ছ, ফিরে চাই বাউড়ি বাতাস, লাইন ০১-০৮
১৮. অলৌকিক সনেটগুচ্ছ, ফিরে চাই বাউড়ি বাতাস, লাইন ০৯-১৪
১৯. অলৌকিক সনেটগুচ্ছ, আবহমান, লাইন ০১-০৬
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি:
০১. কাবেদুল ইসলাম/নৈঃশব্দের কালবেলা, ১ম সংস্করণ, মে ১৯৮৭ খ্রি.। প্রকাশক শেখ আবদুল কাদের, খুলনা
০২. কাবেদুল ইসলাম/তোমার জন্যে কবিতা, ১ম সংস্করণ, জুলাই ১৯৯১ খ্রি.। কথকথা প্রকাশনী, বগুড়া
০৩. কাবেদুল ইসলাম/অলৌকিক সনেটগুচ্ছ, ১ম সংস্করণ, জুন ২০০২ খ্রি.। কথকথা প্রকাশনী, খুলনা
০৪. কাবেদুল ইসলাম/অন্তর্গত দ্বৈরথ, ১ম সংস্করণ, জুন ২০০২ খ্রি.। কথকথা প্রকাশনী, খুলনা
০৫. কাবেদুল ইসলাম/আধুনিক বাংলা কাব্যপাঠের ভূমিকা, ১ম (জয়তী) সংস্করণ, এপ্রিল ২০১১ খ্রি., জয়তী প্রকাশনী, ঢাকা
০৬. জীবনানন্দ দাশ/কবিতার কথা, ২য় (বিশ^সাহিত্য কেন্দ্র) সংস্করণ, মে ২০১২ খ্রি., বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রকাশনা, ঢাকা
০৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/সাহিত্যের পথে, ১ম(কবি প্রকাশনী) সংস্করণ, মে ১৯৮৭ খ্রি., কবি প্রকাশনী, ঢাকা
08. Percy Bysshe Shelley/Selected Poems, 5th Edition, 1995, Unique Publishers, New Delhi
09. Robert Frost/Selected Poems, 12th Edition, 2011, Unique Publishers, New Delhi.
10. William Wordsworth/Selected Poems, 8th Edition, 1998, Unique Publishers, New Delhi.

No comments:

অপেক্ষা

  অপেক্ষা ই ম রু ল কা য়ে স মাঘের হিমবাহ শেষে এলো ফাগুন, এলো বসন্ত বসন্তের আগমনে পুষ্পে পুষ্পে ভরে গেলো বিষন্ন প্রকৃতি; প্রজাপতি রঙ ছড়ালো,...