Sunday, October 22, 2023

কলকাতা ভ্রমণ: পর্ব ছয়

 

কলকাতা ভ্রমণ: পর্ব ছয়
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি★রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়★রবীন্দ্র মিউজিয়াম★নাখোদা মসজিদ
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি:
কলকাতার রবীন্দ্র সরণিতে(পূর্বনাম চিৎপুর রোড) অবস্থিত নোবেল বিজয়ী প্রথম এশিয়ান, বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জনস্থানের নাম ‘জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি’। ঐতিহ্যবাহী এই প্রাচীন বাড়িটিই বাংলার নবজাগরণ ও শিল্প-সাহিত্যের অন্যতম আঁতুড়ঘর; বাঙালির অহঙ্কার ও আবেগের তীর্থস্থান। ১৮৬১ সালের ০৭ মে এই বাড়িতেই কবিগুরু জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ৭ আগস্ট, ১৯৪১ সালে তিনি এখানেই দেহত্যাগ করেন।
এই বাড়িকে ঘিরে অনেক ইতিহাস শোনা যায়। বাড়ির ইতিহাস অনুসন্ধান করার আগে আমাদেরকে জানতে হবে ‘নীলমণি ঠাকুর’ সম্পর্কে। নীলমণি ঠাকুর ছিলেন রবীঠাকুরের ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের ঠাকুরদাদা।
নীলমণি ঠাকুরের পৈতৃক নিবাস ছিল বাংলাদেশের খুলনা শহরের সন্নিকটে পিঠাভোগ গ্রামে। ভ্রাতৃবিয়োগের কারণে পৈতৃক ভিটা ছেড়ে তিনি কলকাতায় এলে এই জায়গাটি তাকে উপহার দেন তদানীন্তন একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী।
নীলমণি ঠাকুরের ছিল তিন পুত্র; রামলোচন ঠাকুর, রামমণি ঠাকুর এবং রামবল্লভ ঠাকুর। রামমণি ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্রের ছিল তিন পুত্র; রাধানাথ, দ্বারকানাথ অর্থ্যাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুরদা ও রমানাথ ঠাকুর। রামবল্লভ ঠাকুরের কোন পূত্র সন্তান না থাকায় তিনি তার ভাইয়ের দ্বিতীয় পুত্র দ্বারকানাথ ঠাকুরকে দত্তক নেন। এই দ্বারকানাথ ঠাকুরই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িটিকে প্রায় ৩৫,০০ স্কয়ার মিটারের বিশাল অবয়বে রুপান্তরিত করেছিলেন।
ইংরেজ শাসনের সুদৃষ্টিতে থেকে এবং আইন ব্যবসার মারপ্যাচ সম্পর্কে সুচতুর থেকে তিনি একটার পর একটা জমিদারী কিনেছিলেন এবং ‘ইউনিয়ন ব্যাংক’ নামে বাংলার প্রথম ব্যাংক স্থাপন করেছিলেন। এছাড়াও নীল, পাট, চা, কয়লা ও জাহাজ ব্যাবসার সাথে সম্পৃক্ত থেকে তিনি সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছিলেন।
ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উত্তরাধিকারী হয়ে এই বাড়ির মাটি স্পর্শ করে ধরণীতে এসেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া ও পাবনা এলাকায় কিছুকাল অবস্থান ব্যাতিত মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি এই বাড়িতেই অবস্থান করেন। বিশ্বকবির স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়ির অন্দরমহল এখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিয়াম।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়:
১৯৬২ সালের ৮ মে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ‘রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’ হলো কলকাতার একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়; বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্রম তালিকায় যা কলকাতার তৃতীয় সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে তাঁর নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের উদ্যোগ ১৯৬১ সালে গৃহীত হয় এবং সেই বছরই পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৬১ পাস করানো হয়েছিল।
কলকাতা শহর ও শহরতলি এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট তিনটি শিক্ষাপ্রাঙ্গন রয়েছে। প্রধান শিক্ষাপ্রাঙ্গণটি কাশীপুরে ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডের মরকত কুঞ্জে, দ্বিতীয় শিক্ষাপ্রাঙ্গনটি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে এবং তৃতীয় শিক্ষাপ্রাঙ্গনটি বিধাননগরে অবস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রাঙ্গণ তিনটির মোট আয়তন ২২.১৯৮ একর ।
রবীন্দ্র মিউজিয়াম:
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তার পরিবারের সদস্যদের রেখে যাওয়া বিভিন্ন ঐতিহাসিক জিনিস-পত্র ও স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে ঠাকুর বাড়ির পুরো অন্দরমহল জুড়ে গড়ে উঠেছে রবীন্দ্র মিউজিয়াম। মাথাপিছু বিশ রুপি এবং বহিরাঙ্গনের ছবি তোলার জন্য মোবাইল প্রতি ৫০ রুপি ফি জমা দিয়ে নাম স্বাক্ষর করে দর্শানার্থীরা রবীন্দ্র মিউজিয়াম পরিদর্শন করতে পারেন।
রবীন্দ্র মিউজিয়াম পরিদর্শনের ইচ্ছে পুরণে পাশে থেকে আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন কলকাতার সিনেম্যটোগ্রাফার ও ক্যামেরা পার্সন মৌসুমী দেবনাথ।
কথা ছিল রবীন্দ্র সরণিতে ঠাকুর বাড়ির প্রধান ফটকে তিনি আমাকে অভ্যার্থণা জানাবেন বেলা বারোটায়। অপরিহার্য কারণে তার আসতে বিলম্ব ঘটায় আমি আরো একটি ভালো কাজ সেরে ফেলতে পারলাম।
ঠাকুর বাড়ির সন্নিকটে, রবীন্দ্র সরণি এবং জাকারিয়া স্ট্রিট এর সংযোগস্থলে অবস্থিত নাখোদা মসজিদ ও মুসাফিরখানার ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে আমি আগেই অবগত ছিলাম। জুম্মা’র নামাজটা যেন নাখোদা মসজিদে আদায় করতে পারি তার একটা ইচ্ছে আগেই করে রেখেছিলাম। মৌসুমীর আসতে দেরী হওয়ায় আমি মুসাফিরখানা পরিদর্শন করি এবং ঐতিহাসিক নাখোদা মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করতে সক্ষম হই...
নাখোদা মসজিদ:
কলকাতার সবচেয়ে বড় মসজিদের হলো নাখোদা মসজিদ। আগ্রা থেকে আগত নাবিক ওসমান সাহেবের নেতৃত্বে একদল ধর্মপ্রাণ মানুষ ১৯২৬ সালে এই মসজিদটি স্থাপন করেন কলকাতার বড়বাজার এলাকায়। ‘নাখোদা’ শব্দটি ফার্সী ভাষা থেকে এসেছে; ফার্সী ভাষায় ‘নাখোদা’ শব্দের অর্থ নাবিক।
এই মসজিদের পাশে আরো একটি মসজিদ ছিল। দুইটি মসজিদকে একত্রিত করে স্থানীয় দানশীল ব্যক্তি হাজী জাকারিয়া সাহেব এই মসজিদের ব্যাপক সংষ্কার করেন। প্রতি ওয়াক্তে প্রায় এক হাজার মুসল্লি এই মসজিদে নামাজ পড়েন। কিন্তু জুম্মার নামাজে, রোজার সময় এবং ঈদের নামাজে এখানের চারপাশ জুড়ে লক্ষাধিক মুসল্লি নামাজ পড়ে থাকেন। সুপরিসর অবয়ব, প্রাচীন ও মনোমুগ্ধকর স্থাপত্যশৈলী আমাকে ভীষণভাবে বিমোহিত করে।
এই মসজিদে স্থানীয় মুসল্লিদের সাথে জামায়াতে জুম্মার নামাজটা পড়তে পেরে আমি মানসিকভাবে প্রফুল্ল বোধ করলাম।
রবীন্দ্র মিউজিয়াম:
জুম্মার নামাজ শেষে পুনরায় ঠাকুর বাড়ির গেটে এসে বন্ধুবর মৌসুমী দেবনাথের সাথে দেখা করি এবং শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে গেট থেকে টিকিট নিয়ে আমরা ভিতোরে প্রবেশ করি।
কবির আঙিনায় পা রাখতেই দেহ-মনে এক ধরনের আরোগ্যময় প্রশান্তি অনুভব করলাম; নয়নাভিরাম স্থাপত্যশৈলী ও ছিমছাম পরিবেশ-প্রতিবেশ দেখে ঠাকুরবাড়ির রাজকীয় আভিজাত্য সম্পর্কে সহজেই আন্দাজ করা যায়। মহর্ষি ভবনের আর একটু কাছে যেতেই কবিগুরুর কৃষ্ণমূর্তি আমাদেরকে অভিভাদন জানালো। বাড়ির অভ্যন্তরে চার দালানের মাঝে সেই ঐতিহাসিক ঠাকুরবাড়ির নাট্যমঞ্চ দেখতে পেলাম, যেখানে রবীন্দ্রনাথসহ তার পরিবারের অন্যান্য সদসস্যরা মাঝে মাঝেই নাটক মঞ্চস্থ করতেন।
কিছুক্ষণ পর জুতো খুলে দো’তলার সিড়ি বেয়ে রবীন্দ্র মিউজিয়ামে প্রবেশ করলাম। রবীঠাকুরের বসার ঘর, পড়ার ঘর, শয়নকক্ষ, ব্যবহৃত আসবাব-পত্র, পোশাকাদি ও দুর্লভ আলোকচিত্র দেখা হলো। মৃনালিনী দেবীর প্রশান্তিময় খোলামেলা রান্নাঘরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। দ্বারকানাথ ঠাকুরের চেয়ার,ঠাকুরবাড়ির আঁতুড়ঘর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা অসাধারণ চিত্রকর্ম ছিল দেখার মতো। কবিগুরুর চিন ও তিব্বত ভ্রমনের আলোকচিত্র, ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণের স্মৃতিচিহ্ন এবং কবির লেখা ও কবিকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন মনীষীর ঐতিহাসিক লেখনি সম্পর্কে জানা হলো। ঠাকুরবাড়িতে রবীঠাকুরের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ছিল ছাঁদ, সেখানেও পা রাখা হলো আমাদের।
অবশেষে, প্রবেশ করলাম কবির মহাপ্রয়াণ কক্ষে, যেখানে তিনি মানবের জন্য অনিবার্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন। বড়সড় একটি অপারেশন থিয়েটারের রেপ্লিকা স্থাপন করা আছে কক্ষের মাঝখানে; পাশে দাঁড়িয়ে আছে একদল বিমর্ষ চিকিৎসক ও নার্স।
ঠাকুরবাড়ির সর্বত্রে, একসাথে-একই রিদমে একটি কেন্দ্রীয় শব্দযন্ত্রের মাধ্যমে রবীঠাকুরের লেখা প্রশান্তিময় জনপ্রিয় গান শোনা গেলো। প্রয়াণকক্ষের বিমর্ষ ভাবনাগুলো প্রশান্তিময় সুরের ইন্দ্রজালে মননতটে নির্মাণ করেছিল ভালোবাসার অদৃশ্য সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে নীচে নেমে এলাম, এগিয়ে গেলাম ঠাকুরবাড়ির গেটে।
হঠাৎ মনে হলো, পিছন থেকে কবিগুরু যেন নিজকণ্ঠে গেয়ে উঠলেন,
‘ভালোবেসে সখি নিঃভৃত যতনে
আমার নামটি লিখ তোমার মনের মন্দিরে…’
একটি এ্যাডভেঞ্চারাস বিয়োগান্তক সিনেমা দেখে প্রেক্ষাগৃহ থেকে ফেরার পর দর্শানর্থিীদের যেমন অনুভব হয়, সেই ধরণের অনুভূতি চোখে-মুখে নিয়ে, ঠাকুরবাড়ির সীমানা পেরিয়ে আমরা হাঁটতে থাকলাম…
দ্বারকানাথ লেন ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের চারখানা পা এক সময় পোঁছে গেলো মাহাত্মা গান্ধী রোডে…
ইমরুল কায়েস/কলকাতা
১৫ অক্টোবর ২০২৩ খ্রি.

No comments:

অপেক্ষা

  অপেক্ষা ই ম রু ল কা য়ে স মাঘের হিমবাহ শেষে এলো ফাগুন, এলো বসন্ত বসন্তের আগমনে পুষ্পে পুষ্পে ভরে গেলো বিষন্ন প্রকৃতি; প্রজাপতি রঙ ছড়ালো,...