কলকাতা ভ্রমণ: পর্ব পাঁচ
রবীন্দ্র সদন, কলকাতা মহানগরীর বাংলা সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্রস্থল। রবীন্দ্র সদনের বৃহৎ মঞ্চ “বাংলা” থিয়েটার ও শহরের অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের একটি প্রধান স্থল এটি। কলকাতায় রবীন্দ্র সদন বাঙালি সমাজের সাংস্কৃতিক ও বিনোদনের এক অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় নাটক, নৃ্ত্য, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রদর্শনী দেখতে পাবেন।
রবীন্দ্র সদনের আশেপাশে অবস্থিত নিম্নলিখিত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলি রবীন্দ্র সদনকে এই ‘আনন্দ নগরী’ কলকাতার এক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র হিসাবে গড়ে তুলেছে। যেমন: রবীন্দ্র সদনের অভ্যন্তরে ভারতের বিখ্যাত কয়েকটি সরকারী প্রতিষ্ঠানের অবস্থান রয়েছে। সেগুলো হলো: পশ্চিমবঙ্গ বাংলা এ্যাকাডেমি, কলকাতা তথ্যকেন্দ্র (দ্য ক্যালকাটা ইনফোরম্যাশন সেন্টার), নন্দন, শিশির মঞ্চ,, বেঙ্গল ফাইন আর্টস এ্যাকাডেমি।
ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রী জওহরলাল নেহেরু ১৯৬১ সালের ৮ই মে কলকাতার রবীন্দ্র সদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু ১৯৬৭ সালের অক্টোবর থেকে এটি জনসাধারণের জন্য খোলা হয়েছিল। কলকাতার রবীন্দ্র সদন আমাদের প্রিয় কবি এবং নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রথম এশিয়ান কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্মানে প্রতিষ্ঠিত হয়।
কলকাতার রবীন্দ্র সদনের পিছন দিকে অবস্থিত নন্দন থিয়েটার হল্, চলচ্চিত্র-প্রেমীদের জন্য একটি আগ্রহদীপ্ত স্থান। কলকাতার জনপ্রিয় চলচ্চিত্র উৎসব নন্দন এবং কলকাতার রবীন্দ্র সদন, এই উভয় স্থানেই অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতা রবীন্দ্র সদন এলাকার আশেপাশের দর্শনীয় আরো বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক জায়গা রয়েছে। যেমন: দ্য ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল, বিড়লা তারামন্ডল, সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রাল, এস.এস.কে.এম হাসপাতাল, দ্য ক্যালকাটা ক্লাব, গোখলে মেমোরিয়্যাল উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ও রবীন্দ্র সদন মেট্রো স্টেশন।
বেঙ্গল ফাইন আর্টস এ্যাকাডেমির গোল চত্তরে গত ১০ অক্টোবর ২০২৩ খ্রি. তারিখে ভাওয়াইয়া গানের আসর নিয়ে কোচবিহার জেলার একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানে আমি আমন্ত্রিত অতিথি ছিলাম।
প্রতিদিন এখানে কোনো না কোনো সংগঠনের অনুষ্ঠান থাকে। সেদিনের সেই অনুষ্ঠানটিও অনেকটা সাদামাঠা কিন্তু সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত ছিল। অতিথির সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের পরেই শুরু হলো নৃত্যানুষ্ঠান । অতঃপর কাক্ষিত সংগীতানুষ্ঠান। দুইজন কণ্ঠশিল্পী একটানা দশটি গান গাইলেন। যা অসাধারণ ছিল।
আমার বন্ধু কলকাতার বিশিষ্ট আবৃত্তিশিল্পী ও আবৃত্তির প্রশিক্ষক নিবেদিতা চৌধুরী এই অনুষ্ঠানে শুরু থেকেই থাকার কথা ছিল। উত্তর দমদম থেকে অনুষ্ঠানে পৌছাতে তিনি কিছুটা দেরী করে ফেলেন। রবীন্দ্র সদনে ঢুকেই তিনি ফোন দিলেন,
-দাদা, আপনি কোথায়? আমি রবীদ্র সদনে প্রবেশ করেছি।
আমি জানালাম, বেঙ্গল ফাইন আর্টস এ্যাকাডেমির গোল চত্তরে।
তিনি আমার দিকে না এসে অন্যদিকে হন্য হয়ে আমাকে খোঁজা শুরু করলেন। আমি তাকে দূর থেকে দেখতে পেলাম। নাম ধরে ডাকলাম। কিন্তু তিনি শুনতে পেলেন না। আমি তার পিছু পিছু হাঁটলাম। আমাকে না পেয়ে তিনি আবার ফোন করলেন। আমি ফোন রিসিভ না করে তাকে সারপ্রাইজ দিতে পিছু পিছু হেঁটেই চললাম। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর আমাকে না পেয়ে তিনি পিছনে তাকালেন। অবাক হয়ে বললেন ,
-আরে দাদা, আপনি এখানে। আমি অনেকক্ষণ আপনাকে খুঁজছি।
-আমি বললাম, সরি দিদি।
তারপর, অনেক্ষণ ঘোরাঘুরি হলো। উন্মুক্ত চত্তরের লেকের পাড়ের চেয়ারে বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করলাম। রবীঠাকুর ও রবীন্দ্র সদনের কার্য়ক্রম নিয়ে অনেক আলাপন হলো। আমার বেশ কয়েকটি কবিতার আবৃত্তি ভালোবেসে তিনি নির্মাণ করেছেন, সেগুলো প্রকাশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলাপ হলো।
ইতোমধ্যে সন্ধ্যা বেশ ঘনিয়ে এলো। এর ফাঁকে ফাঁকে বেশ কিছু ছবি তোলা হলো; কোনোটা আমি একা, কোনোটায় আমরা দু’জন। কথা বলতে বলতে লেকের পাড়ের অপেক্ষাকৃত নির্জন ও সরু রাস্তা দিয়ে আমরা হেঁটে বের হয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।
নিবেদিতা হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠলেন এবং বললেন,
-দাদা, দ্রুত হাঁটুন।
আমি তার পিছনে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম হঠাৎ কেন তিনি দ্রুত হাঁটলেন এবং কেনই বা আমাকে দ্রুত হাঁটতে বললেন।
কিছুদূর আসার পর কারণটি আমি স্পস্ট বুঝতে পারলাম। কিছু সংখ্যক টিনেজার ছেলেমেয়ের আপত্তিকর সহাবস্থান আমাকে খানিকটা বিব্রত করলো।
আমি মনে মনে ভাবলাম, আলোর নীচেই বুঝি অন্ধকার থাকে। রবীন্দ্র সদনের মতো একটি পবিত্রতম স্থানেও সভ্যতার অন্ধকার জমে আছে। নিবেদিতার মতো সুপরিচিত একজন সেলিব্রিটি শিল্পীর জন্য জায়গাটা বিব্রতকর হওয়াটাই স্বাভাবিক।
আমরা এলাকা থেকে দ্রুত বের হলাম। অতঃপর, পার্শবর্ত্তী বিখ্যাত একটি ধাবা ‘হলদি রামে’ প্রবেশ করলাম। জনতার বিশাল ভিড়। আমরাও বসলাম। তিনি আমার ক্ষুধা-তৃষ্ণার চাহিদা মেটালেন, এখানের সুস্বাদু খাবার দিয়েই।
যেহেতু, সন্ধ্যার পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাত্রিও নেমে এসেছে। নিবেদিতা বললেন ,
-দাদা, আমার আর সময় দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। এখান থেকে আমার বাড়ি অনেক দূর এবার যেতে হবে। চলুন, আপনাকে কিছুটা এগিয়ে দিয়ে যাই।
-আমি আমার বললাম, আমাকে নয়। চলুন আপনাকে এগিয়ে দেই।
আমরা মেট্রো রেলের আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে পৌঁছে তার জন্য টিকেট নিলাম। মেট্রো থামার সাথে সাথে আমাকে বিদায় জানিয়ে তিনি তাতে দ্রুত উঠে পড়লেন।
মাটির প্রায় ৩০ ফুট নীচ দিয়ে নিবেদিতার মেট্রোরেল শো শো, শো শো করে উত্তর দিকে চলে গেলো...
আমি কৃতজ্ঞ চিত্তে তার দ্রুত প্রস্থানের পথটি মুখস্থ করতে থাকলাম আর মনে মনে ভাবলাম ‘বাঙালি মেয়েরা এমনই লক্ষ্মী হয়’...
ভীষণ ব্যস্ততা সত্বেও একজন বা্ংলাদেশী লেখক বন্ধুকে আতিথেয়তা ও সময় দিতে তিনি প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দূর থেকে আমার কাছে ছুটে এসেছেন।
মেট্রোরেল তাকে ছোঁ মেরে তুলে নেওয়ায় কৃতজ্ঞতা জানোর সুযোগটাও পাওয়া গেলো না…
ইমরুল কায়েস/কলকাতা
১৪ অক্টোবর ২০২৩ খ্রি.
No comments:
Post a Comment