Monday, September 23, 2024

অপেক্ষা

 

অপেক্ষা
ই ম রু ল কা য়ে স
মাঘের হিমবাহ শেষে এলো ফাগুন, এলো বসন্ত
বসন্তের আগমনে পুষ্পে পুষ্পে ভরে গেলো বিষন্ন প্রকৃতি;
প্রজাপতি রঙ ছড়ালো, ফিরে এলো মৌ মুখরিত মধুকর
তবু, তুমি এলে না।
চৈত্রের দাবদাহ শেষে এলো বৈশাখ, এলো বর্ষা
বর্ষার সতেজতায় সবুজের আল্পনা আঁকা হলো;
পুষ্প-পল্লবহীন মায়াবৃক্ষে ফিরে এলো প্রমত্ত যৌবন
তবু, তুমি এলে না।
নবগঙ্গার টলমল জলে কিশোরী পা দু’টো ভিজালো না
শরৎ অপরাহ্নে নিঃষ্পাপ দু'টি ছায়া পাশাপাশি বসলো না
অনেকগুলো অভিমানী বছর নিঃষ্ফল ঝরে যাবার পর
সফেদ পাঞ্জাবি পরে আবার ফিরে এলো শরৎ।
কবিতা- তোমাকে ভীষণ মনে পড়ছে...
গ্রীষ্ম গেলো, বর্ষা ফুরালো শীতের মতোই, এখন শরৎ।
যদি চাও দেখা হতে পারে নবগঙ্গা তীরে;
পুরনো সেই পাখি ডাকা, ফলে ঢাকা
স্মৃতিময় কাশফুলে ঠাসা, চেনা বালুচরে।

Friday, September 13, 2024

কাবেদুল ইসলাম

 

কাবেদুল ইসলাম এর কবিতায় প্রকৃতি
ই ম রু ল কা য়ে স
"সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি"০১ - কবি জীবনানন্দ দাশের এই প্রমিত সুন্দর শিল্পতত্বের নিরিখে কবি ও কবিতার মানদণ্ড নিরুপন করা বড়ই দুরুহ। মোটা কথায় বলতে গেলে, যারা কবিতা লেখেন তাদেরকে আমরা ‘কবি’ বলে থাকি, আর একজন কবি সাধারণতঃ যা লিখে থাকেন তাই ‘কবিতা’। কিন্তু একজন কবির লেখা ছন্দোময় মনোমুগ্ধকর রসাত্মক পঙক্তিমালা কবিতার শিল্পগুণ বিচারে কতোটা উত্তীর্ণ কিম্বা কবিতার লেখক তার শিল্পসত্ত্বার বিচারে কতোটা পারঙ্গম তা নিয়ে ঢের বিতর্ক হতে পারে।
"কে যেন ভিতোর থেকে আমাকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নেয়।"০২ কবি কাবেদুল ইসলাম তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ তোমার জন্যে কবিতার ভূমিকায় নিজেই স্বীকার করেছেন এই কবিতার গুঢ়তত্ত্ব। কবিতা সম্পর্কে কবির একান্ত ব্যক্তিগত ও অকপট এই উচ্চারণ কবিতার অর্থ ও চরিত্র নির্ধারণে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ - এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। একই পরম্পরায় তিনি বলেছেন-
“... কবিতা বলতে আমি বুঝি স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ, উজ্জ্বল, দৃঢ় এক জীবনসত্যের মহৎ মন্ত্রোচ্চারণ, যা কবির রক্ত ও স্বেদ, হৃদয় ও মনন, অভিজ্ঞতা ও বোধি থেকে উৎজাত। ফলে কবিতা যা বলেন, তা মূলতঃ কবির মননে-মানসে ও জীবনচর্চায় পূর্বেই আলোড়িত, চর্চিত, প্রতিফলিত। এই অর্থে আমার কাছে কবিতা তাই-ই যা জীবন, তা-ই জীবন যা কবিতা।” ০৩
মূলতঃ কবিতা হলো শব্দে ও ছন্দে আবেগের স্বতঃস্ফুর্ত বহিঃপ্রকাশ; ছন্দেময় রসসিক্ত পঙক্তিমালা। সাহিত্যের সবচেয়ে ঘন, জীবনসম্পৃক্ত, শিল্পসমৃদ্ধ ও রসাত্মক শিল্পবিভাজনের সবচেয়ে জনপ্রিয় নামটিই কবিতা। কবিতার ফেরিওয়ালা কাবেদুল ইসলামও একজন কবি; মূলতঃ রোমান্টিক কবি। আধুনিকতা ও রোমান্টিকতার সমন্বিত যোগসূত্রে, যুগল স্রোততরঙ্গে তিনি তার কবিতায় লাগিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন মাধূর্যের প্রলেপ। বলাবাহুল্য, প্রেম ও প্রকৃতি সেখানে শক্তিশালী ও অপরিহার্য এবং এক অপরের সম্পুরক অনুষঙ্গ।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘সাহিত্যের পথে’ প্রবন্ধে লিখেছেন- “আধুনিকতা হলো প্রবাহমান নদীর সুস্পষ্ট শেষবাঁক।”০৪ আমাদের সাহিত্যের চিরন্তন প্রবাহমানতায় কাবেদুল ইসলামের কবিতাও রয়ে যাবে স্বমহিমায়। প্রবাহমান স্রোতস্বিনীর সুস্পষ্ট বাঁক অতিক্রম করে আধুনিকতার সিঁড়িতে তার কবিতার শিল্পাসন কোথায় হবে সেটা গবেষণার বিষয়। কিন্তু আজকের প্রসঙ্গ ভিন্ন; বিশেষ লক্ষ্য অভিমুখে সত্য উৎঘাটনের শৈল্পিক অন্বেষণ ছাড়া আমাদের বাইরে পরিক্রমণের সুযোগ নেই।
বলাবাহুল্য, শিরোনামের মধ্যেই স্পষ্ট রয়েছে আমাদের আজকের প্রসঙ্গ; ‘কাবেদুল ইসলামের কবিতায় প্রকৃতি’। লক্ষ্যের শেষপ্রান্তে পৌঁছতে আমাদেরকে অবশ্যই কয়েকটি শব্দ; যেমন প্রকৃতি, কবি ও কবিতা, কাবেদুল ইসলামের কবিসত্বা ও তার কবিতার স্বরুপ বিশ্লেষণ করা দরকার।
কবি কাবেদুল ইসলামের জন্ম খুলনা শহরে। শৈশব ও কৈশোরের বিচরণক্ষেত্র এই শহরের ফেরিঘাট, শেখপাড়া, তারের পকুর ও বানরগাঁতী এলাকা। বাবা শেখ জোয়াদ আলী এবং মা আনোয়ারা আলীর মধ্যবিত্ত¡ সংসারে তিনি তৃতীয় সন্তান। সঙ্গতকারণে তার লেখালেখিতে মধ্যবিত্ত; ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন, সংসারের ভিতোর ও বাহিরের পরিবেশ-প্রতিবেশ, মানবপ্রেম, প্রেমের গতিপথে গেঁথে থাকা চিরন্তন প্রতিবন্ধকতা, বিরহ, মননস্পর্শিত সমসাময়িক বিষয়াবলী, দ্রোহ, মিলন ও সাম্যবাদের অনুরণন এবং প্রকৃতি ও প্রাকৃতজ উপাদান অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। স্পষ্টতঃ আমাদের আজকের অনুষঙ্গ তার কবিতা; প্রকৃতি কীভাবে তার কবিমানসকে সংক্রমিত করেছে; কীভাবে তার সংক্রমিত অন্তর্জগৎ ও কবিতার শরীর বিনির্মাণে প্রকৃতি অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে তার স্বরুপ বিশ্লেষণ করা।
এক.
‘নৈশব্দের কালবেলা’; কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশকাল: মে ১৯৮৭ খ্রি.। প্রকাশক শেখ আবদুল কাদের। খুলনা থেকে প্রকাশিত।
কবির অন্তর্জগত নিঃসৃত, প্রগাঢ় বিরহমিশ্রিত নৈরাশ্যবোধ ও মিলনের সুতীব্র অগ্নিআকাঙ্ক্ষার তুমুল বজ্জ্রবৃষ্টিপাত এই গ্রন্থখানির কবিতার শারীরিক অবয়বকে করেছে মহিমান্বিত। স্বতঃস্ফুর্ত আবেগের অকপট ও সাবলীল বহিঃপ্রকাশ কবির কবিসত্ত্বাকে দিযেছে নিজস্বতা; স্বতন্ত্র রচনাশৈলী ও ব্যক্তিনির্মিত উপমার ছড়াছড়িতে গ্রন্থখানি অনন্য।
‘নীলার কাছে শেষ চিঠি’ কবিতাটি কবির সীমাহীন বিরহবোধ ও নিসঃঙ্গতার পোড়াকষ্টের ধোয়ায় আচ্ছন্ন। শরৎচন্দ্রের দেবদাসের মতো উদাসীন, ভাবলেশহীন ও বিষন্নতাভরা এক জীবনের খণ্ডচিত্র প্রকাশ পেয়েছে কবিচরিত্রে। নীলাকে সম্বোধন করে কবির অনুযোগ-
“দূরে সবুজাভ লোকালয়, গাছ্গাছালির মায়া,
আমরা এখানে নিরালায় দু’জনে একান্ত পাশে,
আদি মানবী তুমি আবক্ষ নগ্ন, ঘাসে গেছ মিশে,
আমি নিঃশ্বাসে তোমার ঘিরে আছি বুনো কায়া।
সেই ঝিল- টলটলে জল-কাকের গভীর চোখ,
ওপাশে কড়ুই শাখে সিক্ত শিশিরে পাখির বাসা,
ঘাসের হলুদ ফুলে ফড়িংগুলো জড়াজড়ি করে,” ০৭
কবির কাছে প্রকৃতি মানে অফুরন্ত প্রশান্তির সরোবর। নৈসর্গিক প্রশান্তির কাছে কবির বারবার ফিরে যাওয়া, বারবার কাছে যাওয়া এবং চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের ফলে কবিতার শব্দচয়নে যুক্ত হয়েছে গাছগাছালি, সবুজাভ লোকালয়, সবুজ ঘাস, বুনো কায়া, ঝিল- টলটলে জল, কাকের গভীর চোখ, কড়ুই শাখা, শিশির, পাখির বাসা, ঘাসের হলুদ ফুল, ঘাসফড়িং ইত্যাদি শব্দসমুহ। এই শব্দসমুহের ব্যবহার কবিতার শরীরে খুবই সাবলীল ও অপরিহার্য; কোনো একটি শব্দকে সরিয়ে নিলে খসে পড়বে কবিতার সমগ্র শরীরপ্রাসাদ।
‘কবেকার প্রাচীন অসুখ’ কবিতায় কবি এক ধরণের মানবিক অসুখে ভোগার কথা উল্লেখ করেছেন। শরীরের ভিতোর অসুখের বিস্তারের সাথে কবি বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা বিস্তারের বিষয়টি উপমিত করেছেন। ইংরেজ কবি Robert Frost তার ‘Tree at My Window’ কবিতায় জানালার পাশে থাকা গাছটির সাথে তার নিজের জীবনের রূঢ় অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেছেন- “Your head is too much concerned with outer,/Mine with inner, weather.” 08 একইভাবে, কবি কাবেদুল ইসলামও নিঃস্ব প্রবীণ বৃক্ষের সাথে তার ব্যক্তি জীবনের কষ্টের অনুভূতি ভাগাভাগি করেছেন-
“এই শ্রাবণের ঝরঝর বৃষ্টিত চিত্রল দিন
এই অনিঃশেষ বেদনার একাকী নিঃসঙ্গ রাত,
হিমদীর্ণ অন্ধকার ক্লান্তিতে শীর্ণ নিঃস্ব প্রবীণ
বৃক্ষের মতো, আমি তো পারি না আর সুঅভিজাত
ক্ষয়রোগ নিয়ে বেঁচে থাকতে, আর কতো বসন্ত
নিঃষ্ফল হবে? সুদীর্ঘ পথ হেঁটে আমি বড়ো ক্লান্ত।” ০৯
দুই.
তোমার জন্যে কবিতা; কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশকাল: জুলাই ১৯৯১ খ্রি.। প্রকাশনা: কথকথা প্রকাশনী। স্থান: বগুড়া।
কবিতার শিল্পগুণ বিচারে, এযাবত প্রকাশিত কবিতার মধ্যে কবির সবচেয়ে মানোত্তীর্ণ এবং সবচেয়ে আবেগময় শক্তিশালী কবিতার বসতি এই কাব্যগ্রন্থে।
এই গ্রন্থের অন্যতম কবিতা- ‘গন্তব্য এখন। তখনকার নোংরা সমাজ, দুঃখী লোকালয় ও চারপাশের মানুষের হিংসা-দ্বেষ কবির অন্তর্জগতকে ভীষণভাবে ব্যথিত করে। চরম নৈরাশ্যবোধের ভাবনা থেকে তিনি মুক্তি পেতে চান; সর্বস্ব বিকিয়ে কবি প্রকৃতির কোলে আশ্রয় পেতে চান। প্রকৃতিআশ্রিত কবির আকুতি-
`এখন ইচ্ছে করে চ’লে যাই সুদূর কোনো কোলাহলহীন দ্বীপে
চারিদিকে যার আকাশ-নীলিমা, সমুদ্রের জলের প্রহার
সুগন্ধ জড়ানো সবুজ বাতাস যেনো শুয়ে আছে
প্রতীক্ষায় উপোষী রমণীর যুগল প্রজাপতির চোখের ভিতোর’১০
এখানে, প্রকৃতিকে কবি মানসিক যন্ত্রণার গ্রাস থেকে আত্মত্রাণের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যেভাবে, একইসুরে ইংরেজ কবি William Wordsworth তার ‘Tintern Abbey’ কবিতায় ব্যক্ত করেছেন- “Nature never did betray/The heart that loved her…” 11
একইভাবে, ‘অনাগত শিশুর প্রতি’- কবিতায় কবি ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের প্রতি বিষোদগার করেছেন। একটি স্বপ্নময় সমাজ বিনির্মাণের প্রত্যাশা করে কবি তার অনাগত শিশুর প্রতি আহ্বান রেখেছেন-
‘তুমি আসছো, বাংলাদেশ নামের একদা উজ্জ্বল সবুজ এক ভূখণ্ডে
তুমি আসছো এখানে
একদা যেখানে ছিল
পাখির ছোট বুকের মতো নরম সবুজ ঘাস
চোখের সামনে খোলা আকাশ, কয়েকটা চিল, কবুতর
অজানা বুনো ফুলের মতো নদীর জলের নোনা গন্ধ’১২
এখানে, প্রেমিকাসদৃশ প্রকৃতির অবক্ষয়ে কবির প্রেমসত্ত্বা দারুণভাবে মর্মাহত হয়েছে। ইংরেজ কবি পার্সি বিশি শেলীর মতো তিনিও প্রথাগত, ক্ষয়ে যাওয়া সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে নতুন এক সম্ভাবনাময় সমাজ ব্যবস্থা বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছেন।
‘তোমার জন্যে কবিতা’- কবিতাটির শিরোনামকেই এই গ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছে। এই কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্যময়তায় কবির সপ্রশংস মুগ্ধতা প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু, তাবৎ মুগ্ধতা দু’হাতে সরিয়ে, পিছনে ফেলে, প্রেমিকার শুভ্র শরীর সরোবরে তিনি নিমেষেই ডুবে যেতে পারেন। কবির অকপট স্বীকারোক্তি-
“চিলেকোঠার ঘুলঘুলিতে রোদ,
কার্ণিশে শর্সে ফুলের মতো হলুদ চড়ুই
রমণীর সিঁথির মতো দূরের পিঙ্গল নদী
এসব কিছু ছেড়ে চ’লে যেতে পারি যদি তোমাকে পাওয়ার
এতোটুকু নিশ্চয়তা পাই।”১৩
কবি অকপটে ঘোষণা করেছেন “এই পৃথিবী শুধুমাত্র তাদের জন্য এবং পাখি ও প্রজাপতির জন্য। হরিণীদের জন্য অরণ্য, হৃদয়ের জন্য প্রেম এবং বৃষ্টির জন্য মৃত্তিকা।” ফলে, কবি, প্রকৃতি ও প্রেমিকা এই কবিতার ত্রিমাত্রিক অপরিহার্য অনুষঙ্গ।
‘পৃথিবী জোড়া বৃষ্ঠিতে’ বৃষ্টির সাথে কবির আজন্মের আত্মীয়তার সম্পর্ক প্রকাশ পেয়েছে। বৃষ্টির মাধ্যমে প্রকৃতি জীবন ফিরে পায়, পরিশুদ্ধতা আসে। জীবনের পরিশুদ্ধতা আনয়ণে কবি তার প্রেমিকাকে আহ্বান করেছেন-
“অতএব অভিমানী নারী, উত্তর জানালা খুলে দাও
কার্ণিসের উপর পড়ুক তুমুল বৃষ্টিপাত
দুধের সরের মতো বৃষ্টি বিষন্ন পৃথিবী জুড়ে থৈ থৈ
ভেসে যাক মাঠঘাট আর বাড়ীঘর অনন্তের জলের খেয়ায়
ভেসে যাক সোনালি গমের ক্ষেত, নিশ্চুপ অন্ধকার অলক্ষ্যে
ধুঁয়ে যাক নর আর নারীদের হৃদয়ের শরীরের পাপ” ১৪
তিন.
অলৌকিক সনেটগুচ্ছে; কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশকাল: জুন ২০০২ খ্রিস্টাব্দ। প্রকাশনা: কথকথা প্রকাশনী। স্থান: খুলনা। ব্যাক কভারে কবির জীবনী বর্ণনায় গ্রন্থের প্রকাশিকা পারভীন ইসলাম শিমুর (যিনি কবির সহধর্মিনী) সরল স্বীকারোক্তি-
“... স্বভবতই এ অঞ্চলের(খুলনাঞ্চলের) নিবিড় সবুজ প্রকৃতি, শস্যশ্যামল ক্ষেত্র, পানের বরোজ, জলবন্দি জনপদ, ধুসর জোয়ারের নদী, অন্ধকার ঝোপঝাড়, বাঁশবনে নিশিরাতের জোছনা-- সবকিছুই তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। অনিবার্যভাবে এসব তাঁর কবিতায় সুচারুরূপে ফুটে উঠেছে।” ১৫
‘ফিরে চাই বাউড়ি বাতাস’ শিরোনামের সনেটে প্রকৃতির সাথে কবির লেপ্টে থাকা জীবনের আটপৌরে সম্পর্কের শাব্দিক চিত্রকল্প স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। যেখানে কবির পিছনে পড়ে আছে-
‘‘... চিহ্নহীন জনপদ।
কাক-মরা গ্রাম, চষাক্ষেত, শস্যের শূণ্য বসন,
কাল স্রোতস্বিনী পদ্মার নিরিবিলি বয়েসী ভাঙন;
... গাঢ় সবুজ টেনে নিয়ে যায় কাছাকাছি
অরণ্যের মধ্যিখানে। গৃহস্থের নিকোনো উঠোন,
লাউডগা ঝুলে থাকে, বনরাজিনীলা গৃহকোণ;
সেই সব শূণ্যতায় বড়বেশী জীর্ণ হয়ে আছি। ” ১৬
প্রকৃতির সাথে কবির অছেদ্য সম্পর্কের কারণে তিনি প্রকৃতির কাছেই চেয়েছেন বেঁচে থাকার অনুষঙ্গ, মৃত্যুর কাছাকাছি যাওয়ার শক্তি এবং সেখান থেকে ফিরে আসার মূলমন্ত্র-
“আবারও জাহাজের পালে চাই বাউড়ি বাতাস
ক্ষিপ্রগামী গাংচিল, মুখোমুখি নদী খোলামেলা,
হাঙরের অন্ধকার অস্থির স্তুপ, পুরোনা মাস,
অনুকূল নোনাপানি। সমুদ্রের গহিন সুরেলা
ডাক নিয়ে যাবে মৃত্যু আর জীবনের কাছে ফের,
শেখাবে যুদ্ধ, মৃত্যুতে বাঁচার মন্ত্র ঢের।” ১৭
জীবন মানেই মৃত্যু অনিবার্য - এই চিরন্তন সত্যটুকু কবি তার প্রিয়তমাকে স্মরণ করিয়ে মিলনের অভিলাষ ব্যক্ত করেছেন। মানবপ্রেম ও প্রকৃতিপ্রেমের সাথে সুস্পষ্ট যোগসূত্র নির্মিত হয়েছে এই কবিতায়, যেখানে জীবনের সাথে বিচ্ছেদ মানেই চিরচেনা পরিবেশ-প্রতিবেশ ও প্রকৃতির সাথে চূড়ান্ত ছাড়াছাড়ি। আবহমান সনেটের অষ্টকে তিনি ‘ছেড়ে যাবো’ মানে জীবনের সাথে লেপ্টে থাকা পারিপার্শিকতার বাহুবন্ধন থেকে হারিয়ে যাবেন বোঝাতে চেয়েছেন-
“একদিন নিশ্চয়ই ছেড়ে যাবো এই রূপবতী
দেশ, সোনালি শস্যের ক্ষেত, বনভূমি, গাছপালা,
মানুষের চেনাজানা গৃহস্থালি, উঠোন, গো-শালা,
প্রিয়তম স্বজনের গহিন কালো চোখের জ্যোতি।
শ্রাবণের কাজল বর্ষা, জলবতী মেঘের পাহাড়,
সারাদিন রিমঝিম আশ্চর্য ভেজাবে পথঘাট, ”১৮
‘সারেং, চলো ফিরে যাই’ কবিতায় জীবনের সওদা নিয়ে বন্দরে বন্দরে নোঙ্গর ফেলা সারেং গৃহের টানে ভীষণ কাতর। প্রাণে প্রাণে ভালোবাসার সওদা ফেরি করা কবিও একসময় জাহাজের সারেং এর মতো চরম ব্যাকুলতা অনুভব করেন; ফিরে যেতে চায় আপন নীড়ে- উত্তর থেকে দক্ষিণে, আরো দক্ষিণে-
“... যেখানে গৃহস্থের নিকোনো উঠোন
শিমের মাচান, লাউডগা, সুপোরির কালো বন,
লাল-পেড়ে শাড়িপরা বধূ রস জানালায় উনুনে;
সোঁদাগন্ধ মাটি, কলমির বুকের নওলা ‘ওম’,
ডাহুকের ডাক, কোড়া কালিমের ছানা, বক, লোম-
ওঠা কুকুরের-শেয়ালের হল্লা, ভোরের স্নিগ্ধতা।” ১৯
তথ্যসুত্র:
০১. জীবনান্দ দাশ/কবিতার কথা, পৃষ্ঠা: ১০, লাইন: ০১
০২. কাবেদুল ইসলাম/তোমার জন্যে কবিতা, ভূমিকা: লাইন ০২-০৩
০৩. কাবেদুল ইসলাম/তোমার জন্যে কবিতা, ভূমিকা: লাইন ১৭-২১
০৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/সাহিত্যের পথে, পৃষ্ঠা: ৪৮, লাইন: ?
০৫. কাবেদুল ইসলাম/নৈঃশব্দের কালবেলা, লাইন: ২৭-৩১
০৬. কাবেদুল ইসলাম/নৈঃশব্দের কালবেলা, লাইন: ৩৫-৩৮
০৭. কাবেদুল ইসলাম/নৈঃশব্দের কালবেলা, লাইন: ০৫-১১
০৮. Robert Frost/Tree at My Window, Line: 15-16
০৯. কাবেদুল ইসলাম/নৈঃশব্দের কালবেলা: লাইন: ০৯-১৪
১০. তোমার জন্যে কবিতা, গন্তব্য এখন, লাইন: ১৭-২০
১১. William Wordsworth/Tintern Abbey, Line: 15-16
১২. তোমার জন্যে কবিতা, অনাগত শিশুর প্রতি, লাইন: ০২-০৭
১৩. Percy Bysshe Shelley/Ode to the West Wind
১৪. তোমার জন্যে কবিতা, তোমার জন্যে কবিতা, লাইন: ০৫-০৯
১৫. তোমার জন্যে কবিতা, পৃথিবী জোড়া বৃষ্টি, লাইন ০৯-১৪
১৬. কাবেদুল ইসলাম/অলৌকিক সনেটগুচ্ছ, কবি-পরিচিতি: লাইন ০২-০৫
১৭. অলৌকিক সনেটগুচ্ছ, ফিরে চাই বাউড়ি বাতাস, লাইন ০১-০৮
১৮. অলৌকিক সনেটগুচ্ছ, ফিরে চাই বাউড়ি বাতাস, লাইন ০৯-১৪
১৯. অলৌকিক সনেটগুচ্ছ, আবহমান, লাইন ০১-০৬
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি:
০১. কাবেদুল ইসলাম/নৈঃশব্দের কালবেলা, ১ম সংস্করণ, মে ১৯৮৭ খ্রি.। প্রকাশক শেখ আবদুল কাদের, খুলনা
০২. কাবেদুল ইসলাম/তোমার জন্যে কবিতা, ১ম সংস্করণ, জুলাই ১৯৯১ খ্রি.। কথকথা প্রকাশনী, বগুড়া
০৩. কাবেদুল ইসলাম/অলৌকিক সনেটগুচ্ছ, ১ম সংস্করণ, জুন ২০০২ খ্রি.। কথকথা প্রকাশনী, খুলনা
০৪. কাবেদুল ইসলাম/অন্তর্গত দ্বৈরথ, ১ম সংস্করণ, জুন ২০০২ খ্রি.। কথকথা প্রকাশনী, খুলনা
০৫. কাবেদুল ইসলাম/আধুনিক বাংলা কাব্যপাঠের ভূমিকা, ১ম (জয়তী) সংস্করণ, এপ্রিল ২০১১ খ্রি., জয়তী প্রকাশনী, ঢাকা
০৬. জীবনানন্দ দাশ/কবিতার কথা, ২য় (বিশ^সাহিত্য কেন্দ্র) সংস্করণ, মে ২০১২ খ্রি., বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রকাশনা, ঢাকা
০৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/সাহিত্যের পথে, ১ম(কবি প্রকাশনী) সংস্করণ, মে ১৯৮৭ খ্রি., কবি প্রকাশনী, ঢাকা
08. Percy Bysshe Shelley/Selected Poems, 5th Edition, 1995, Unique Publishers, New Delhi
09. Robert Frost/Selected Poems, 12th Edition, 2011, Unique Publishers, New Delhi.
10. William Wordsworth/Selected Poems, 8th Edition, 1998, Unique Publishers, New Delhi.

Saturday, July 27, 2024

মননতটে মোহন বৃষ্টি

 

মননতটে মোহন বৃষ্টি

চোখের কোণে মেঘ জমেছে, বৃষ্টি হবে?
বৃষ্টি হলো দ্রোহানলে জ্বলতে থাকা মেঘের কষ্ট।
বৃষ্টি হবে? বৃষ্টি?
মনাত্বরে, মননতটে, মোহন বৃষ্টি?

কষ্টগুলো মেঘের মতোন, কষ্ট হবে?
ব্যথার তোড়ে ঝরে পড়ে চোখে জলে।
কষ্ট হবে? কষ্ট?
চোখেরতটে ব্যথার পলল, নীলকষ্ট?

দুঃখগুলো বারিধারা, দুঃখ হবে?
বরফ হয়ে ঝরে পড়ে, হিংসাঘাতে, বজ্জ্রপাতে
দুঃখ হবে? দুঃখ?
গহনমনে পুঞ্জিভূত পোষা কষ্ট?

১৯ অক্টোবর ২০১৮ খ্রি.
০৪ কার্তিক, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ
খুলনা


Friday, February 23, 2024

চেতনার ফুল

 

চেতনার ফুল
ই ম রু ল কা য়ে স
এই দুরন্ত ফাগুনে, বাঙালির মননে মননে
ভালোবাসার রঙ মাখানো অজস্র বর্ণিল ফুল ফুটুক।
অহঙ্কারী শিমুল, অভিমানী পারুল আর কুমারী গোলাপ
এক হয়ে মিশে যাক কৃষ্ণচূড়ার মিছিলে মিছিলে।
মননের বিমুগ্ধ বারান্দায়, মৌ মৌ সুগন্ধি ফুলগুলো
মেতে উঠুক ফাগুনের এই দুরন্ত মিষ্টি হাওয়াও।
কষ্ট ভুলে দুলে উঠুক লাল টকটকে পাপড়ি
সুমিষ্ট ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ুক আকাশে-বাতাসে।
একটি লাল টকটকে চেতনার ফুল ফুটুক
নতুন প্রজন্মের মগজে-মননে
হৃদয়ের এক চিলতে উঠোনে, নিঃষ্পাপ কোমল যত্নে
রোপিত হোক চেতনার বীজ, অঙ্কুরিত হোক চারাগাছ,
সৌরভে, গৌরবে বেঁচে থাকুক অনন্তকাল।
অজস্র চেতনার ফুল ফুটুক, হৃদয়ে, হৃদয়ে।
সালামের অব্যক্ত কথামালা, জব্বারের শেষ অশ্রুফোঁটা
রফিকের রক্তের বুদবুদ, শফিকের সোনালি স্বপ্ন
আর বরকতের বুকফাঁটা কষ্টের আর্তনাদ
আষ্টে-পৃষ্ঠে লেগে থাকুক তাাতে...

Sunday, January 28, 2024

আমার যদি থাকতো ডানা


আমার যদি থাকতো ডানা

ই ম রু ল  কা য়ে স

আমার যদি পাখির মতো থাকতো ডানা পালকের
যেতাম উড়ে অনেক দূরে উৎসমূলে আলোকের।

দূর আকাশে যেতাম উড়ে মন পবনে দিয়ে ভর
চন্দ্রদীপে ঘর বানিয়ে যেতাম থেকে জীবন ভর।

যখন খুশি ইচ্ছে মতো দিতাম শরীর ভাসিয়ে
মস্ত বড় এই জীবনের দুঃখগুলো নাশিয়ে।

কল্পলোকের স্বর্গ ভুলে ফিরতে হবে তবু যে
বাংলাদেশের পাহাড়-নদী ফসলের ক্ষেত সবুজে।

০২ মে ২০০৯
১৯ বৈশাখ ১৪১৬ বঙ্গাব্দ
খুলনা

Friday, January 26, 2024

ছড়া খুব কড়া


ছড়া খুব কড়া
ই ম রু ল  কা য়ে স

ছড়া খুব কড়া ভাই চাও যদি শিখতে
প্রথমেই যেতে হবে ছন্দটা শিখতে।

তারপর ভারী চাই শব্দের ঝোলাটা
তাল লয় ঠিক রেখে চাই হাত খোলাটা।

পঙক্তিতে হবে ভাই মাত্রা গুনতে
চরণের শেষে মিল রাখা চাই বুনতে।

এই ভাবে চোখ কান খোলা রেখে চর্চা
করে গেলে পেয়ে যাবে ভালো ছড়ার  পর্চা।

৩ মে ২০০৯ খ্রি.
২০ বৈশাখ ১৪১৬ বঙ্গাব্দ
খুলনা

হাত কড়া

 

হাত কড়া
(গৃহপরিচারিকা নির্যাতন বিষয়ক নাটিকা)
ই ম রু ল  কা য়ে স

চরিত্রসমুহ:
সালাম সাহেব: কলেজ শিক্ষক
বীথি: গৃহিনী
রোজি: গৃহপরিচারিকা
সাহেদ সাহেব: আইনজীবী, সালাম সাহেবের বন্ধু
ফাতিমা নূর: থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা
কনস্টাবল: উর্দি পরিহিত একজ কনস্টাবল 

(সকাল নয়টা। সালাম সাহেব ও তার স্ত্রী ড্রইং রুমে আলাপরত। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠবে... ক্রিং ক্রিং ক্রিং)
সালাম সাহেব: রোজি। এই রোজি।
রোজি: জী আঙ্কেল। কী হইছে?
সালাম সাহেব: দেখতো, কে আসলো? পরিচিত হলে দরোজা খুলবি। নইলে খুলবি না।
রোজি: জী, আইচ্ছা। আমি দেখতাছি।

(লুকিং গ্লাসের ভিতোর দিয়ে লোকটাকে দেখে রোজি দরোজা খুলবে এবং সালাম দিবে। অতঃপর সাহেদ সাহেব ঘরে প্রবেশ করে এবং ড্রইং রুমের দিকে আসবেন।)
সালাম সাহেব: আরে সাহেদ ভাই  যে। গরীবের দরোজায় হািতীর পাড়া দেখছি। ভালো আছেন নিশ্চয়ই? বসেন, বসেন ভাই।
সাহেদ সাহেব: আরে বলেন কী? ভালো না থাকলে এখানে আসলাম কী করে? বীথি ভাবী, আপনি ভালো আছেন তো?
বীথি: হ্যাঁ, ভাই। এই চলছে আর কি! কাজের ছেমড়িটা নিয়ে বিশাল যন্ত্রণায় আছি, ভাই।
সাহেদ সাহেব: কে ভাবী? সে আবার কী করলো?
বীথি: ও আর বলবেন না ভাই। কথা বোঝে না, কাজ বোঝে না। যখন তখন মাল-জিনিস ভাঙ্গে। আমার জীবন একদম অতিষ্ট করে তুললো। একটা মুর্খ, রাবিশ। গ্রাম থেকে ধরে এনেছে আপনার প্রাণের বন্ধু।
সালাম সাহেব: আচ্ছা ! এখন থামো তো। মেহমানের সামনে তুমি এসব কথা তুলছো কেন? নতুন নতুন সবাই একটু একটু ভুল করে। কিছুদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।
সাহেদ সাহেব: হ্যাঁ, ভাবী। একটু কষ্ট করে কাজগুলো বুঝিয়ে দিন। দেখবেন সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে।
বীথি: আরে, নারে ভাই! ঠিক না ছাঁই হবে। বানরের লেজ কিছুতেই সোজা হয় না। গুনে গুনে আর মাত্র তিন দিন দেখবো। ওকে না তাড়ালে আমি পিটিয়ে ওকে ঘর থেকে বের করে দেবো।

(এমন সময় রোজি ট্রেতে নাস্তা ও শরবতের গ্লাস নিয়ে ড্রইং রুমে ঢুকবে। টেবিলে পরিবেশনের সময় হাত থেকে পড়ে গিয়ে একটি গ্লাস ভেঙে যাবে।)

বীথি: এই জানোয়ারের বাচ্চা, তুই এ কী করলি? আমার দামী গ্লাসটা ভেঙ্গে ফেললি। তোরে আজ মেরেই ফেলবো।


(রোজিকে চড়-থাপ্পড় মারতে মারতে বীথি রান্না ঘরে নিয়ে যাবে।খুনতি দিয়ে নির্মমভাবে মারতে থাকবে। দূর থেকে পিটানোর শব্দ ও কান্নার শব্দ ভেসে আসবে।)

সালাম সাহেব: সাহেদ ভাই, আপনি একটু বসেন। আমি আসছি। পরিস্থিতি িএকটু সামাল দিয়ে আসি।
সাহেদ সাহেব: হ্যাঁ, ভাই। আপনি ভিতোরে যান। ভাবীবে বোঝান। পরিস্থিতি সামাল দেন।

(একটু পরে সালাম সাহেব ফিরে আসবে। মারার শব্দও কমে যাবে।)

সালাম সাহেব: আমি যারপর নাই দুঃখিত, সাহেদ ভাই। আপনার ভাবী মাঝে একটু মাত্রাতিরিক্ত করে ফেলে, ভাই।

সাহেদে সাহেব: মেয়েটি কিন্তু খুব একটা অন্যায় করেনি। বড় মানুষের হাত থেকেও তো গ্লাসটা পড়ে ভেঙ্গে যেতে পারতো! তাছাড়া ও তো একনো শিশু।

সালাম সাহেব: আমি খুব লজ্জিত, ভাই।

সাহেদ ভাই: সালাম ভাই, ভাবীবে কিন্তু বোঝাতে হবে। উনি কিন্তু ভুল করে যাচ্ছেন। একটা বড় বিপদে পড়তে পারেন আপনারা। আমি কিন্তু আইনের লোক, আপনাদের সাবধান করে যাচ্ছি। আইন কিন্তু আপনাদের বিপক্ষে যাবে।

সালাম সাহেব: এসব বুছেই তো আপনার ভাবীকে অনবরত বুঝিয়ে যাচ্ছি।

সাহেদ সাহেব: সালাম ভাই, এবার বিদায় চাচ্ছি। আজ আর বসতে পারছি না। আমার একটু তাড়া আছে। অন্য একটি আবার আসবো।

সালাম সাহেব: অবশ্যই আসবেন। ভাবীকে সাথে নিয়ে আসবেন। আর শরীরের প্রতি যত্ন নিবেন, ভাই।

সাহেদ সাহেব: ঠিক আছে। আল্লাহ হাফেজ।

(সালাম সাহেব দরোজা লাগিয়ে রান্না ঘরে প্রবেশ করবেন। রান্নাঘরের মেঝেতে শুয়ে রোজি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকবে। ওর ক্ষতস্থানে মলম লাগিয়ে দিয়ে তিনি বীথির ঘরে যাবেন এবং গলার স্বর মোটা করে তিনি বীথিকে বলবেন...)

কাজটা তুমি মোটেই ভালো করোনি, বীথি। ভদ্রতা এবং আইনের সীমা দুটোই তুমি লঙ্ঘন করেছো। আমি ওকে আগামী সপ্তাহে বাড়ীতে রেখে আসবো। ওর গায়ে যেন আর হাত দেওয়া না হয়। আমি কলেজে চলে যাচ্ছি। এবারের মতো সহ্য করলাম।

(সালাম সাহেব ল্যাপটপের ব্যাগ নিয়ে দ্রুত বের হয়ে যাবেন। কিছুক্ষণ পর বীখি বেড রুম থেকে রান্না ঘরে প্রবেশ করবে।)

বীথি: এই ফকিরের বাচ্চা আমাকে অপমান করে তুই এখনো শয়ে আছিস? থালা বাসন ধোঁবে কে? বাথরুমে একগাদা কাপড়-চোপড় ভেজানো সেগুরো ধোঁবে কে?

রোজি: আমার অনেক লাগছে খালাম্মা। গতরডা ব্যথা করতাছে।আমি তো হাত নাড়াতে পারছি না।খালাম্মা, হু হু হু ...

বীথি: কী বললি! তোর এতো বড় সাহস! এতোগুলো থালা-বাসন, কাপড়-চোপড় ধোঁবে তোর ভাতার?  বান্দির বাচ্চা... তোকে দেখাচ্ছি মজা।

(রোজিকে উপুরযুপরি থাপ্পড়, লাথি মারতে থাকবে সে। এক পর‌্যায়ে রুটিবলা বেলন দিয়ে পিঠে ও ঘাঁড়ে মারতে থাকবে। আঘাত সহ্য করতে না পেরে ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যাবে িএবং দৌড়াদে থাকবে রোজি...)


কিছুক্ষণ পর। কলিংবেল বেজে উঠবে। ক্রিং, ক্রিং ক্রিং...

বীথি: (ঘরের ভিতর থেকে) কে?
ফাতিমা নূর: থানা থেকে আসছি । দরোজা খোলেন।
বীথি: (দরোজা খুলে বলবে) আপনারা কাকে চান?
ফাতিমা নূর: এটা কি সালাম সাহেবের বাসা?
বীথি: জীঁ,হ্যাঁ। কিন্তু কী হয়েছে?
ফাতিমা নূর: আপনি কি তার স্ত্রী?
বীথি: জীঁ, হ্যাঁ। কিন্তু কেন?
ফাতিমা নূর: আপনার স্বমী কোথায়? উনাকে ডাকেন।

(বীথি তার স্বমীকে ফোন করে বাসায় আসতে বলবেন। সালাম সাহেব দ্রুত হন্তদন্ত হয়ে বাসায় ঢুকবেন। ঘরের ভিতোরে পুলিশের লোকজন দেখে অবাক হয়ে তিনি প্রশ্ন করবেন..)

সালাম সাহেব: কী হয়েছে অফিসার?

ফাতিমা নূর: আপনার দাজ্জাল স্ত্রী একটি তেরো বছরের বাচ্চাকে নির্দয়ভাবে প্রহার করেছেন। এমনিতেই তাকে দিয়ে আপনারা শিশুশ্রম করেছেন! তারপর আপনার স্ত্রী আধমরা করে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন।মেয়েটি এলাকার পথঘাট কিছুিই চেনে না। মহল্লার রোকজনের সহযোগিতায় সে এখন আমাদের হেফাজতে আছে।

সালাম সাহেব: আমি আমার স্ত্রীর জন্য ক্ষমা চাচ্ছি, অফিসার। আমাদেরকে এবারের মতো ক্ষমা করে দেন।

ফাতিমা নূর: আপনার ক্ষমা চাইতে হবে না। আপনি মেয়েটিকে আগে হাসপাতালে ভর্তি করে সুস্থ করে তুলবেন। তারপর তাকে তার বাবার হাতে গ্রামের বাড়িতে রেখে আসবেন।

সালাম সাহেব: ঠিক আছে , অফিসার। আমি তাকে সুস্থ করে তার বাবার হাতে পৌঁছে দেবো।

ফাতিমা নূর: আর আপনার বেগম সাহেবা মারাত্মকভাবে আইন ভঙ্গ করেছেন। মেয়েটিকে মারধর করেছেন। শিশুশ্রম নিরোধ আইন এবং নারী ও শিশু নির‌্যাতন আইন ভঙ্গ করায় আমরা তাকে গ্রেফতার করলাম। কনস্টাবল।

কনস্টাবল: ইয়েস স্যার। 
ফাতিমা নূর: মহিলাকে হাতকড়া পরাও এবং তানায় নিয়ে চলো।
কনস্টাবল: ইয়েস স্যার। (কনস্টাবল বীথিকে হাতকড়া পরাবে)
সালাম সাহেব: আমার স্ত্রীকে ছেড়ে দিন প্লিজ। প্লিজ অফিসার। এখন থেকে আমি আমার স্ত্রীর দায়িত্ব নিবো।
ফাতিমা নূর: রাখেন আপনার স্ত্রীর কথা। আপনি শিক্ষক মানুষ। আগে সমাজের দায়িত্ব নেন। সমাজের কথা ভাবেন। শিশুশ্রম ও শিশু নির‌্যাতন বন্ধে মনুষকে সচেতন করে তোলেন। সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেন আইন ভঙ্গ করলে তার শাস্তি আপনার দাজ্জাল স্ত্রীর মতোই হবে।

(বীথিকে নিয়ে পুলিশ গাড়িতে উঠবে। সালাম সাহেব চলন্ত গাড়রি দিকে নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকবে)

সমাপ্ত


Monday, October 30, 2023

Seven Three One Seven Two Two

 

Seven Three One Seven Two Two
Imrul Kayes

Hello. Hello... Is there anyone?
Is it seven three one seven two two?
No response.
Hello, I’m still waiting to be connected.
Sorry, connection is impossible!

How many days have to burn for you?
How many dials will go in vain?
How long I’ve to wait...
a day, a month, a year or more!
It is urgent to be connected.
It is very urgent to expose my heart.
The boughs of coconut tree want to seduce her
The Neem trees also have evil intention
She is certainly unsecured.
It is urgent to be connected
It is very urgent to expose my heart.
For the last time...
Hello. Hello... Is there anyone?
Hello, seven three one seven two two?
No response.
Hello, are you still alright, dear?
Dead silence everywhere!
Therefore, the story is over.
Imrul Kayes
23 Augustl 2012
Khulna.

Sunday, October 22, 2023

কলকাতা ভ্রমণ: পর্ব ছয়

 

কলকাতা ভ্রমণ: পর্ব ছয়
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি★রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়★রবীন্দ্র মিউজিয়াম★নাখোদা মসজিদ
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি:
কলকাতার রবীন্দ্র সরণিতে(পূর্বনাম চিৎপুর রোড) অবস্থিত নোবেল বিজয়ী প্রথম এশিয়ান, বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জনস্থানের নাম ‘জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি’। ঐতিহ্যবাহী এই প্রাচীন বাড়িটিই বাংলার নবজাগরণ ও শিল্প-সাহিত্যের অন্যতম আঁতুড়ঘর; বাঙালির অহঙ্কার ও আবেগের তীর্থস্থান। ১৮৬১ সালের ০৭ মে এই বাড়িতেই কবিগুরু জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ৭ আগস্ট, ১৯৪১ সালে তিনি এখানেই দেহত্যাগ করেন।
এই বাড়িকে ঘিরে অনেক ইতিহাস শোনা যায়। বাড়ির ইতিহাস অনুসন্ধান করার আগে আমাদেরকে জানতে হবে ‘নীলমণি ঠাকুর’ সম্পর্কে। নীলমণি ঠাকুর ছিলেন রবীঠাকুরের ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের ঠাকুরদাদা।
নীলমণি ঠাকুরের পৈতৃক নিবাস ছিল বাংলাদেশের খুলনা শহরের সন্নিকটে পিঠাভোগ গ্রামে। ভ্রাতৃবিয়োগের কারণে পৈতৃক ভিটা ছেড়ে তিনি কলকাতায় এলে এই জায়গাটি তাকে উপহার দেন তদানীন্তন একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী।
নীলমণি ঠাকুরের ছিল তিন পুত্র; রামলোচন ঠাকুর, রামমণি ঠাকুর এবং রামবল্লভ ঠাকুর। রামমণি ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্রের ছিল তিন পুত্র; রাধানাথ, দ্বারকানাথ অর্থ্যাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুরদা ও রমানাথ ঠাকুর। রামবল্লভ ঠাকুরের কোন পূত্র সন্তান না থাকায় তিনি তার ভাইয়ের দ্বিতীয় পুত্র দ্বারকানাথ ঠাকুরকে দত্তক নেন। এই দ্বারকানাথ ঠাকুরই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িটিকে প্রায় ৩৫,০০ স্কয়ার মিটারের বিশাল অবয়বে রুপান্তরিত করেছিলেন।
ইংরেজ শাসনের সুদৃষ্টিতে থেকে এবং আইন ব্যবসার মারপ্যাচ সম্পর্কে সুচতুর থেকে তিনি একটার পর একটা জমিদারী কিনেছিলেন এবং ‘ইউনিয়ন ব্যাংক’ নামে বাংলার প্রথম ব্যাংক স্থাপন করেছিলেন। এছাড়াও নীল, পাট, চা, কয়লা ও জাহাজ ব্যাবসার সাথে সম্পৃক্ত থেকে তিনি সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছিলেন।
ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উত্তরাধিকারী হয়ে এই বাড়ির মাটি স্পর্শ করে ধরণীতে এসেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া ও পাবনা এলাকায় কিছুকাল অবস্থান ব্যাতিত মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি এই বাড়িতেই অবস্থান করেন। বিশ্বকবির স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়ির অন্দরমহল এখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিয়াম।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়:
১৯৬২ সালের ৮ মে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ‘রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’ হলো কলকাতার একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়; বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্রম তালিকায় যা কলকাতার তৃতীয় সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে তাঁর নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনের উদ্যোগ ১৯৬১ সালে গৃহীত হয় এবং সেই বছরই পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৬১ পাস করানো হয়েছিল।
কলকাতা শহর ও শহরতলি এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট তিনটি শিক্ষাপ্রাঙ্গন রয়েছে। প্রধান শিক্ষাপ্রাঙ্গণটি কাশীপুরে ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডের মরকত কুঞ্জে, দ্বিতীয় শিক্ষাপ্রাঙ্গনটি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে এবং তৃতীয় শিক্ষাপ্রাঙ্গনটি বিধাননগরে অবস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রাঙ্গণ তিনটির মোট আয়তন ২২.১৯৮ একর ।
রবীন্দ্র মিউজিয়াম:
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তার পরিবারের সদস্যদের রেখে যাওয়া বিভিন্ন ঐতিহাসিক জিনিস-পত্র ও স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে ঠাকুর বাড়ির পুরো অন্দরমহল জুড়ে গড়ে উঠেছে রবীন্দ্র মিউজিয়াম। মাথাপিছু বিশ রুপি এবং বহিরাঙ্গনের ছবি তোলার জন্য মোবাইল প্রতি ৫০ রুপি ফি জমা দিয়ে নাম স্বাক্ষর করে দর্শানার্থীরা রবীন্দ্র মিউজিয়াম পরিদর্শন করতে পারেন।
রবীন্দ্র মিউজিয়াম পরিদর্শনের ইচ্ছে পুরণে পাশে থেকে আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন কলকাতার সিনেম্যটোগ্রাফার ও ক্যামেরা পার্সন মৌসুমী দেবনাথ।
কথা ছিল রবীন্দ্র সরণিতে ঠাকুর বাড়ির প্রধান ফটকে তিনি আমাকে অভ্যার্থণা জানাবেন বেলা বারোটায়। অপরিহার্য কারণে তার আসতে বিলম্ব ঘটায় আমি আরো একটি ভালো কাজ সেরে ফেলতে পারলাম।
ঠাকুর বাড়ির সন্নিকটে, রবীন্দ্র সরণি এবং জাকারিয়া স্ট্রিট এর সংযোগস্থলে অবস্থিত নাখোদা মসজিদ ও মুসাফিরখানার ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে আমি আগেই অবগত ছিলাম। জুম্মা’র নামাজটা যেন নাখোদা মসজিদে আদায় করতে পারি তার একটা ইচ্ছে আগেই করে রেখেছিলাম। মৌসুমীর আসতে দেরী হওয়ায় আমি মুসাফিরখানা পরিদর্শন করি এবং ঐতিহাসিক নাখোদা মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করতে সক্ষম হই...
নাখোদা মসজিদ:
কলকাতার সবচেয়ে বড় মসজিদের হলো নাখোদা মসজিদ। আগ্রা থেকে আগত নাবিক ওসমান সাহেবের নেতৃত্বে একদল ধর্মপ্রাণ মানুষ ১৯২৬ সালে এই মসজিদটি স্থাপন করেন কলকাতার বড়বাজার এলাকায়। ‘নাখোদা’ শব্দটি ফার্সী ভাষা থেকে এসেছে; ফার্সী ভাষায় ‘নাখোদা’ শব্দের অর্থ নাবিক।
এই মসজিদের পাশে আরো একটি মসজিদ ছিল। দুইটি মসজিদকে একত্রিত করে স্থানীয় দানশীল ব্যক্তি হাজী জাকারিয়া সাহেব এই মসজিদের ব্যাপক সংষ্কার করেন। প্রতি ওয়াক্তে প্রায় এক হাজার মুসল্লি এই মসজিদে নামাজ পড়েন। কিন্তু জুম্মার নামাজে, রোজার সময় এবং ঈদের নামাজে এখানের চারপাশ জুড়ে লক্ষাধিক মুসল্লি নামাজ পড়ে থাকেন। সুপরিসর অবয়ব, প্রাচীন ও মনোমুগ্ধকর স্থাপত্যশৈলী আমাকে ভীষণভাবে বিমোহিত করে।
এই মসজিদে স্থানীয় মুসল্লিদের সাথে জামায়াতে জুম্মার নামাজটা পড়তে পেরে আমি মানসিকভাবে প্রফুল্ল বোধ করলাম।
রবীন্দ্র মিউজিয়াম:
জুম্মার নামাজ শেষে পুনরায় ঠাকুর বাড়ির গেটে এসে বন্ধুবর মৌসুমী দেবনাথের সাথে দেখা করি এবং শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে গেট থেকে টিকিট নিয়ে আমরা ভিতোরে প্রবেশ করি।
কবির আঙিনায় পা রাখতেই দেহ-মনে এক ধরনের আরোগ্যময় প্রশান্তি অনুভব করলাম; নয়নাভিরাম স্থাপত্যশৈলী ও ছিমছাম পরিবেশ-প্রতিবেশ দেখে ঠাকুরবাড়ির রাজকীয় আভিজাত্য সম্পর্কে সহজেই আন্দাজ করা যায়। মহর্ষি ভবনের আর একটু কাছে যেতেই কবিগুরুর কৃষ্ণমূর্তি আমাদেরকে অভিভাদন জানালো। বাড়ির অভ্যন্তরে চার দালানের মাঝে সেই ঐতিহাসিক ঠাকুরবাড়ির নাট্যমঞ্চ দেখতে পেলাম, যেখানে রবীন্দ্রনাথসহ তার পরিবারের অন্যান্য সদসস্যরা মাঝে মাঝেই নাটক মঞ্চস্থ করতেন।
কিছুক্ষণ পর জুতো খুলে দো’তলার সিড়ি বেয়ে রবীন্দ্র মিউজিয়ামে প্রবেশ করলাম। রবীঠাকুরের বসার ঘর, পড়ার ঘর, শয়নকক্ষ, ব্যবহৃত আসবাব-পত্র, পোশাকাদি ও দুর্লভ আলোকচিত্র দেখা হলো। মৃনালিনী দেবীর প্রশান্তিময় খোলামেলা রান্নাঘরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। দ্বারকানাথ ঠাকুরের চেয়ার,ঠাকুরবাড়ির আঁতুড়ঘর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা অসাধারণ চিত্রকর্ম ছিল দেখার মতো। কবিগুরুর চিন ও তিব্বত ভ্রমনের আলোকচিত্র, ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণের স্মৃতিচিহ্ন এবং কবির লেখা ও কবিকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন মনীষীর ঐতিহাসিক লেখনি সম্পর্কে জানা হলো। ঠাকুরবাড়িতে রবীঠাকুরের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ছিল ছাঁদ, সেখানেও পা রাখা হলো আমাদের।
অবশেষে, প্রবেশ করলাম কবির মহাপ্রয়াণ কক্ষে, যেখানে তিনি মানবের জন্য অনিবার্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন। বড়সড় একটি অপারেশন থিয়েটারের রেপ্লিকা স্থাপন করা আছে কক্ষের মাঝখানে; পাশে দাঁড়িয়ে আছে একদল বিমর্ষ চিকিৎসক ও নার্স।
ঠাকুরবাড়ির সর্বত্রে, একসাথে-একই রিদমে একটি কেন্দ্রীয় শব্দযন্ত্রের মাধ্যমে রবীঠাকুরের লেখা প্রশান্তিময় জনপ্রিয় গান শোনা গেলো। প্রয়াণকক্ষের বিমর্ষ ভাবনাগুলো প্রশান্তিময় সুরের ইন্দ্রজালে মননতটে নির্মাণ করেছিল ভালোবাসার অদৃশ্য সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে নীচে নেমে এলাম, এগিয়ে গেলাম ঠাকুরবাড়ির গেটে।
হঠাৎ মনে হলো, পিছন থেকে কবিগুরু যেন নিজকণ্ঠে গেয়ে উঠলেন,
‘ভালোবেসে সখি নিঃভৃত যতনে
আমার নামটি লিখ তোমার মনের মন্দিরে…’
একটি এ্যাডভেঞ্চারাস বিয়োগান্তক সিনেমা দেখে প্রেক্ষাগৃহ থেকে ফেরার পর দর্শানর্থিীদের যেমন অনুভব হয়, সেই ধরণের অনুভূতি চোখে-মুখে নিয়ে, ঠাকুরবাড়ির সীমানা পেরিয়ে আমরা হাঁটতে থাকলাম…
দ্বারকানাথ লেন ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের চারখানা পা এক সময় পোঁছে গেলো মাহাত্মা গান্ধী রোডে…
ইমরুল কায়েস/কলকাতা
১৫ অক্টোবর ২০২৩ খ্রি.

কলকাতা ভ্রমণ: পর্ব পাঁচ

 

কলকাতা ভ্রমণ: পর্ব পাঁচ

রবীন্দ্র সদন, কলকাতা মহানগরীর বাংলা সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্রস্থল। রবীন্দ্র সদনের বৃহৎ মঞ্চ “বাংলা” থিয়েটার ও শহরের অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের একটি প্রধান স্থল এটি। কলকাতায় রবীন্দ্র সদন বাঙালি সমাজের সাংস্কৃতিক ও বিনোদনের এক অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় নাটক, নৃ্ত্য, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রদর্শনী দেখতে পাবেন।
কলকাতা ময়দানের দক্ষিণ-পূর্ব কেন্দ্রে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু রোড এবং ক্যাথিড্রাল রোডের সংযোগস্থলে কলকাতার রবীন্দ্র সদন অবস্থিত। রবীন্দ্র সদন এলাকায়, রবীন্দ্র সদন মঞ্চ, নন্দন, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা এ্যাকাডেমি, গগনেন্দ্র প্রদর্শনশালা নিয়ে গঠিত, এগুলি সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের প্রধান কেন্দ্র।
রবীন্দ্র সদনের আশেপাশে অবস্থিত নিম্নলিখিত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলি রবীন্দ্র সদনকে এই ‘আনন্দ নগরী’ কলকাতার এক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র হিসাবে গড়ে তুলেছে। যেমন: রবীন্দ্র সদনের অভ্যন্তরে ভারতের বিখ্যাত কয়েকটি সরকারী প্রতিষ্ঠানের অবস্থান রয়েছে। সেগুলো হলো: পশ্চিমবঙ্গ বাংলা এ্যাকাডেমি, কলকাতা তথ্যকেন্দ্র (দ্য ক্যালকাটা ইনফোরম্যাশন সেন্টার), নন্দন, শিশির মঞ্চ,, বেঙ্গল ফাইন আর্টস এ্যাকাডেমি।
ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শ্রী জওহরলাল নেহেরু ১৯৬১ সালের ৮ই মে কলকাতার রবীন্দ্র সদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু ১৯৬৭ সালের অক্টোবর থেকে এটি জনসাধারণের জন্য খোলা হয়েছিল। কলকাতার রবীন্দ্র সদন আমাদের প্রিয় কবি এবং নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রথম এশিয়ান কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্মানে প্রতিষ্ঠিত হয়।
কলকাতার রবীন্দ্র সদনের পিছন দিকে অবস্থিত নন্দন থিয়েটার হল্, চলচ্চিত্র-প্রেমীদের জন্য একটি আগ্রহদীপ্ত স্থান। কলকাতার জনপ্রিয় চলচ্চিত্র উৎসব নন্দন এবং কলকাতার রবীন্দ্র সদন, এই উভয় স্থানেই অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতা রবীন্দ্র সদন এলাকার আশেপাশের দর্শনীয় আরো বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক জায়গা রয়েছে। যেমন: দ্য ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল, বিড়লা তারামন্ডল, সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রাল, এস.এস.কে.এম হাসপাতাল, দ্য ক্যালকাটা ক্লাব, গোখলে মেমোরিয়্যাল উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ও রবীন্দ্র সদন মেট্রো স্টেশন।
বেঙ্গল ফাইন আর্টস এ্যাকাডেমির গোল চত্তরে গত ১০ অক্টোবর ২০২৩ খ্রি. তারিখে ভাওয়াইয়া গানের আসর নিয়ে কোচবিহার জেলার একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানে আমি আমন্ত্রিত অতিথি ছিলাম।
প্রতিদিন এখানে কোনো না কোনো সংগঠনের অনুষ্ঠান থাকে। সেদিনের সেই অনুষ্ঠানটিও অনেকটা সাদামাঠা কিন্তু সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত ছিল। অতিথির সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের পরেই শুরু হলো নৃত্যানুষ্ঠান । অতঃপর কাক্ষিত সংগীতানুষ্ঠান। দুইজন কণ্ঠশিল্পী একটানা দশটি গান গাইলেন। যা অসাধারণ ছিল।
আমার বন্ধু কলকাতার বিশিষ্ট আবৃত্তিশিল্পী ও আবৃত্তির প্রশিক্ষক নিবেদিতা চৌধুরী এই অনুষ্ঠানে শুরু থেকেই থাকার কথা ছিল। উত্তর দমদম থেকে অনুষ্ঠানে পৌছাতে তিনি কিছুটা দেরী করে ফেলেন। রবীন্দ্র সদনে ঢুকেই তিনি ফোন দিলেন,
-দাদা, আপনি কোথায়? আমি রবীদ্র সদনে প্রবেশ করেছি।
আমি জানালাম, বেঙ্গল ফাইন আর্টস এ্যাকাডেমির গোল চত্তরে।
তিনি আমার দিকে না এসে অন্যদিকে হন্য হয়ে আমাকে খোঁজা শুরু করলেন। আমি তাকে দূর থেকে দেখতে পেলাম। নাম ধরে ডাকলাম। কিন্তু তিনি শুনতে পেলেন না। আমি তার পিছু পিছু হাঁটলাম। আমাকে না পেয়ে তিনি আবার ফোন করলেন। আমি ফোন রিসিভ না করে তাকে সারপ্রাইজ দিতে পিছু পিছু হেঁটেই চললাম। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর আমাকে না পেয়ে তিনি পিছনে তাকালেন। অবাক হয়ে বললেন ,
-আরে দাদা, আপনি এখানে। আমি অনেকক্ষণ আপনাকে খুঁজছি।
-আমি বললাম, সরি দিদি।
তারপর, অনেক্ষণ ঘোরাঘুরি হলো। উন্মুক্ত চত্তরের লেকের পাড়ের চেয়ারে বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করলাম। রবীঠাকুর ও রবীন্দ্র সদনের কার্য়ক্রম নিয়ে অনেক আলাপন হলো। আমার বেশ কয়েকটি কবিতার আবৃত্তি ভালোবেসে তিনি নির্মাণ করেছেন, সেগুলো প্রকাশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলাপ হলো।
ইতোমধ্যে সন্ধ্যা বেশ ঘনিয়ে এলো। এর ফাঁকে ফাঁকে বেশ কিছু ছবি তোলা হলো; কোনোটা আমি একা, কোনোটায় আমরা দু’জন। কথা বলতে বলতে লেকের পাড়ের অপেক্ষাকৃত নির্জন ও সরু রাস্তা দিয়ে আমরা হেঁটে বের হয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।
নিবেদিতা হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠলেন এবং বললেন,
-দাদা, দ্রুত হাঁটুন।
আমি তার পিছনে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম হঠাৎ কেন তিনি দ্রুত হাঁটলেন এবং কেনই বা আমাকে দ্রুত হাঁটতে বললেন।
কিছুদূর আসার পর কারণটি আমি স্পস্ট বুঝতে পারলাম। কিছু সংখ্যক টিনেজার ছেলেমেয়ের আপত্তিকর সহাবস্থান আমাকে খানিকটা বিব্রত করলো।
আমি মনে মনে ভাবলাম, আলোর নীচেই বুঝি অন্ধকার থাকে। রবীন্দ্র সদনের মতো একটি পবিত্রতম স্থানেও সভ্যতার অন্ধকার জমে আছে। নিবেদিতার মতো সুপরিচিত একজন সেলিব্রিটি শিল্পীর জন্য জায়গাটা বিব্রতকর হওয়াটাই স্বাভাবিক।
আমরা এলাকা থেকে দ্রুত বের হলাম। অতঃপর, পার্শবর্ত্তী বিখ্যাত একটি ধাবা ‘হলদি রামে’ প্রবেশ করলাম। জনতার বিশাল ভিড়। আমরাও বসলাম। তিনি আমার ক্ষুধা-তৃষ্ণার চাহিদা মেটালেন, এখানের সুস্বাদু খাবার দিয়েই।
যেহেতু, সন্ধ্যার পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাত্রিও নেমে এসেছে। নিবেদিতা বললেন ,
-দাদা, আমার আর সময় দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। এখান থেকে আমার বাড়ি অনেক দূর এবার যেতে হবে। চলুন, আপনাকে কিছুটা এগিয়ে দিয়ে যাই।
-আমি আমার বললাম, আমাকে নয়। চলুন আপনাকে এগিয়ে দেই।
আমরা মেট্রো রেলের আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে পৌঁছে তার জন্য টিকেট নিলাম। মেট্রো থামার সাথে সাথে আমাকে বিদায় জানিয়ে তিনি তাতে দ্রুত উঠে পড়লেন।
মাটির প্রায় ৩০ ফুট নীচ দিয়ে নিবেদিতার মেট্রোরেল শো শো, শো শো করে উত্তর দিকে চলে গেলো...
আমি কৃতজ্ঞ চিত্তে তার দ্রুত প্রস্থানের পথটি মুখস্থ করতে থাকলাম আর মনে মনে ভাবলাম ‘বাঙালি মেয়েরা এমনই লক্ষ্মী হয়’...
ভীষণ ব্যস্ততা সত্বেও একজন বা্ংলাদেশী লেখক বন্ধুকে আতিথেয়তা ও সময় দিতে তিনি প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দূর থেকে আমার কাছে ছুটে এসেছেন।
মেট্রোরেল তাকে ছোঁ মেরে তুলে নেওয়ায় কৃতজ্ঞতা জানোর সুযোগটাও পাওয়া গেলো না…
ইমরুল কায়েস/কলকাতা
১৪ অক্টোবর ২০২৩ খ্রি.

অপেক্ষা

  অপেক্ষা ই ম রু ল কা য়ে স মাঘের হিমবাহ শেষে এলো ফাগুন, এলো বসন্ত বসন্তের আগমনে পুষ্পে পুষ্পে ভরে গেলো বিষন্ন প্রকৃতি; প্রজাপতি রঙ ছড়ালো,...